ফিরে দেখা ২০২৪
অনেকটাই স্থবির অর্থনীতি, রিজার্ভে সামান্য স্বস্তি
বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।
শ্বেতপত্রে অর্থনীতির দুর্দশার ব্যবচ্ছেদ।
জুলাই-আগস্টের ধকল কাটাতে পারছে না রাজস্ব খাত।
পটপরিবর্তনের পর প্রকল্পের অনেক ঠিকাদার নিরুদ্দেশ।
নেতিবাচক সব অর্থনৈতিক সূচক নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৪। আগস্ট মাসে যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে, অর্থনীতি তখন রীতিমতো সংকটে। চাপ সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও গত প্রায় পাঁচ মাসে গতি পায়নি অর্থনীতি। এ সময়ে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো অর্থনীতির সংকটকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শ্বেতপত্রের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের ব্যাপক লুটপাটের চিত্রও উঠে এসেছে।
এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছেন। ডলারের দাম ১২০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিছুটা ইতিবাচক আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বাকি প্রায় সব সূচকই তলানিতে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণ–আন্দোলনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা কাটছে না। চাঁদাবাজি চলছে, যদিও চাঁদাবাজ বদলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, অর্থনীতিকে সংকটে রেখেই বিদায় নিচ্ছে ২০২৪।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বড় বড় পদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ‘জঞ্জাল’ সরাতেই অর্থনৈতিক নেতৃত্ব মূলত গত পাঁচ মাস ব্যস্ত ছিলেন।
সংকটকবলিত একটি অর্থনীতি নিয়েই ২০২৪ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থনীতি এখন গতি হারিয়েছে।
বছরের ভিলেন মূল্যস্ফীতি
বিদায়ী বছরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ে। টানা আট মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। এমনকি শীতের এ মৌসুমে সরবরাহ বাড়লেও শাকসবজির দাম খুব বেশি কমেনি। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।
সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশেই থেকেছে। কিন্তু জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ছে। ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে, কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি।
শ্বেতপত্রের আয়নায় অর্থনীতির করুণ চিত্র
২০২৪ সালের অন্যতম বড় উদ্যোগ ছিল অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ। পদে পদে দুর্নীতির কারণে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা উঠে এসেছে প্রথমবারের মতো নেওয়া এ উদ্যোগে। বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, গড়ে প্রতিবছর গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
দেড় দশকে সরকারি কেনাকাটা থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রকল্প থেকে লুটপাট হয়েছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। আর শেয়ারবাজার থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতির যা অবস্থা
ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাজস্ব খাত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। প্রতি মাসেই আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে ছিল এনবিআর।
উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমেছে। আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ অনেক ঠিকাদার পালিয়ে থাকার কারণে এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগের বছরের তুলনায় জুলাই-নভেম্বর সময়ে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে।
তবে ভালো খবর হলো অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রপ্তানি ও প্রবাসে আয়ে কিছুটা গতি এসেছে। চার মাস ধরে প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসী আয়ে প্রায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে নানামুখী পদক্ষেপের কারণে গত পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ভালো হওয়ায় তা রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকিয়েছে।
তবে খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে নামে-বেনামে যেসব ঋণ নেওয়া নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪ সালের অর্থনীতিকে দুই ভাগে দেখতে হবে। একটি আগের সরকারের আমলের, অপরটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরের অংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আর্থসামাজিক খাতে অগ্রগতি সত্ত্বেও অর্থনীতির ভেতরে বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। যেমন বণ্টনের অন্যায্যতা, ক্রয়ক্ষমতার অবনমন, বিনিময় হারে বড় ধস, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পেছনেও অর্থনীতির পুঞ্জীভূত সমস্যা ভূমিকা রেখেছে।
মোস্তাফিজুর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অর্থনীতি ও সুশাসন নিয়ে বড় প্রত্যাশা রয়েছে। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে। বৈষম্য ও বণ্টনের ন্যায্যতা—এসব বিষয় আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এখনো অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান। যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবনমনের অব্যাহত ধারা। অন্তর্বর্তী সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, বাজার তদারকির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্থনীতির অনেক সূচকে পরিবর্তন আনতে পারেনি, অর্থনীতি গতি পায়নি।