সবার আগে দরকার আর্থিক খাতের সংস্কার: সিপিডির সংলাপে বক্তারা

আর্থিক খাতের সংস্কারকে এখন সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। এটি জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট ও অনিয়ম, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ–সংকট, রাজস্ব খাতের নৈরাজ্য, ব্যবসায় দুর্বল পরিবেশ—এসব বিষয়ে সংস্কার করা উচিত। ব্যাংক খাতের সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে নৈরাজ্যের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, গত দেড় দশকে ব্যবসায়ীদের নানাভাবে মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে।

রাজধানীর একটি হোটেলে আজ বুধবার সংলাপটির আয়োজন করা হয়। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে সংলাপে বক্তারা বলেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য সমাজে বঞ্চনা তৈরি করেছে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এখন অর্থনীতির প্রতিটি সূচক তলানিতে আছে। এসব সূচক পুনরুদ্ধার করতে হবে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

ভঙ্গুর ব্যাংক খাত

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। আমরা একটি দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। ব্যাংক খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাত যতটা খারাপ বলা হচ্ছে, বাস্তবে এর চেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখন ‘রিব্র্যান্ড’ করতে হবে।

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, যাঁরা ব্যাংক লুটপাট করেছেন, তাঁদের বিদেশে যাওয়া আটকাতে হবে। তাঁদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে অর্থের হিসাব মিলাতে হবে। তিনি আরও বলেন, এনবিআর এখন ঘুষের হাট, ঘুষের সরদার এর চেয়ারম্যান (আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, গতকাল বিকেলে যাঁর চুক্তি বাতিল করা হয়)। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কত দিন থাকবে, সেই বিষয়েও স্পষ্ট বক্তব্য থাকা দরকার।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। আমরা একটি দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। ব্যাংক খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

সংবিধান আছে কি নেই, তা নিয়ে বিতর্ক

সংলাপের একপর্যায়ে বর্তমানে সংবিধান কার্যকর আছে কি নেই, তা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। দেশের সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে সংবিধানের যে অবস্থা, তা মেরামতযোগ্য নয়। এটা ‘রিরাইট’ (পুনরায় লেখা) করার অবস্থায় চলে গেছে।

এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম জানতে চান, তিনি নতুন সংবিধান চান কি না। তখন মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘আমি ঠিক বাতিল বলছি না।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দেশ সংবিধানের মধ্যে আছি কি না, তা পরিষ্কার করার পরামর্শ দেন সরকারকে। তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার গঠিত হয়েছে। তাহলে আমরা কি সংবিধানের মধ্যে আছি?’

বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি বিপ্লবী সরকার, তা-ও পরিষ্কার করা উচিত।

এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আইনজ্ঞরা ঠিক করবেন, এটা কী ধরনের সরকার। অনেকে বলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে বলে এটি বিপ্লবী সরকার। আবার সরকারি তরফ থেকে বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সংস্কার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, আন্দোলনের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এখন দেশ গঠনে জনগণ যত দিন সংস্কার চাইবে, তত দিন আন্দোলন চলবে। অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। একটি দেশে গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, তা দেখে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে থাকেন। তিনি আরও বলেন, যে সংস্কার ২৪ ঘণ্টায় করা সম্ভব, তা যেন ২৫ ঘণ্টায় করা না হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বরকত ই খুদা বলেন, এখন দেশে একটি সার্বিক সংস্কার দরকার। আগামী তিন-চার মাস সময় দিয়ে দরকার ব্যাংক, পুলিশ, বিচার বিভাগ—এসব বিষয়ে সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা। ১৯৯১ সালেও এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ও ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারপারসন আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা উচিত।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দেন। তিনি বলেন, জিডিপির অনুপাতে এই দুটি খাতে বিনিয়োগের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নিচে।

অন্যান্য

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ২৫টি মন্ত্রণালয় থাকার যুক্তি নেই। সরকার হয়েছে, শাসনব্যবস্থা নেই। শাসনব্যবস্থাকে জায়গায় আনতে হবে।

বিডিজবসডটকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর মনে করেন, আন্দোলনের সময় কী কী সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমাদের অধিকার বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, তা নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করার উচিত।

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘শুনেছি, অনেকে সেনা হেফাজতে আছেন। আমাদের জানার অধিকার আছে, তাঁরা কারা? তাঁদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।’

সংলাপে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, এনজিও কর্মী, সাবেক আমলাসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন।