বেড়ে যাচ্ছে খরচ, দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা

শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানি, পণ্য রপ্তানি ও বাজারজাতে দুই দফা বাড়তি খরচ গুনতে হবে। দিন শেষে এ খরচের চাপ পড়বে জনগণের কাঁধে।

তিন মাসের ব্যবধানে চার ধরনের সংকটে পড়ে ভুগছে শিল্প খাত। এ চার সংকট হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকট, ডলার–সংকট, আমদানির ঋণপত্র খুলতে বিলম্ব ও আমদানি দায় পরিশোধে বাড়তি খরচ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলো বাড়তি পরিবহন খরচ ও উৎপাদন ব্যয়।

ডিজেলের দাম বাড়ায় শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানিতে একবার এবং রপ্তানি পণ্য বন্দরে পৌঁছানো বা দেশে বাজারজাতের সময় আরেকবার বাড়তি খরচ গুনতে হবে। আবার লোডশেডিংয়ের সময় ডিজেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পণ্য উৎপাদন খরচেও কিছুটা প্রভাব পড়বে। উৎপাদনমুখী খাতের উদ্যোক্তারা শুরুতে খরচ গুনলেও দিন শেষে এ বাড়তি খরচের চাপ পড়বে ক্রেতার ওপর।

সরকার গত শুক্রবার চার ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে। শিল্প খাতে প্রভাব পড়বে মূলত ডিজেলের দাম বাড়ায়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাবে, জ্বালানির মধ্যে শিল্প খাতে ডিজেলের ব্যবহার প্রায় ৭ শতাংশ। আবার যোগাযোগ খাতে জ্বালানির ব্যবহার ৬৩ শতাংশ, যার মধ্যে বেশির ভাগই ডিজেল। ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়ানোয় জ্বালানি খরচ সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়বে।

রপ্তানিমুখী ও আমদানি প্রতিস্থাপক কারখানাগুলো মূলত কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির পর কারখানায় নেওয়ার সময় এসব পণ্য পরিবহনে একবার বাড়তি খরচ দিতে হবে। আবার উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রামের ডিপোগুলোতে নেওয়ার জন্য আরেকবার বাড়তি খরচ গুনতে হবে। যেসব পণ্য রপ্তানি হয় না, সেগুলো দেশের অভ্যন্তরে বাজারজাতের সময়ও বাড়তি খরচ গুনতে হবে। অর্থাৎ একই পণ্যে দুই দফা পরিবহন খরচ যুক্ত হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২১–২২ অর্থবছরে দেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর ও সব স্থলবন্দর দিয়ে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ টন পণ্য আমদানি হয়। এসব পণ্যের বেশির ভাগেরই গন্তব্য ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের কারখানা। আমদানি পণ্যের বড় অংশই শিল্পের প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল। আবার গত অর্থবছরে দেশের সব বন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে ৬৭ লাখ ৭৯ হাজার টন পণ্য রপ্তানি হয়। এর বাইরে দেশের অভ্যন্তরে সোয়া তিন কোটি টন সিমেন্ট, অর্ধকোটি টনের বেশি রড এবং ঢেউটিনের মতো শিল্পপণ্য পরিবহন হয়।

পণ্য পরিবহনের ভাড়া এখনো ঘোষণা দেয়নি পরিবহন সংগঠনগুলো। তবে তারা নিজেরা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। পরিবহন ভাড়া কত বাড়বে, তার ওপর নির্ভর করে টনপ্রতি খরচের ভার কত হবে।

টনপ্রতি সর্বোচ্চ খরচ সড়কপথে, নৌপথে কম

আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় স্টেশন চট্টগ্রাম বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে সারা দেশে পণ্য আনা-নেওয়া হয়। পণ্য পরিবহনের গাড়ির মালিক ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার গাজীপুর পর্যন্ত ছয় চাকার প্রতিটি গাড়িতে সর্বোচ্চ ১৩ টন পণ্য পরিবহন করা যায়। জ্বালানি খরচ হয় কমবেশি ৭০ লিটার। সেই হিসাবে আমদানি পণ্য নেওয়ার জন্য প্রতিবার ২ হাজার ৩৮০ টাকার ডিজেল পোড়াতে হবে। এতে টনপ্রতি খরচ বাড়বে ১৮৩ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ৬৯ পয়সা। আবার গাজীপুর থেকে চট্টগ্রামের ডিপোগুলো পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ হবে টনপ্রতি ৩৪০ টাকা। রপ্তানি পণ্যের ওজন কম হওয়ায় খরচ বাড়বে, যদিও রপ্তানিতে পণ্য পরিবহন খরচ আমদানির তুলনায় কম।

শিল্প খাতে সাধারণত গাড়ি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বছরভিত্তিক চুক্তি করে কোম্পানিগুলো। বিভিন্ন চুক্তি অনুযায়ী দেখা গেছে, জ্বালানির দাম বাড়ানোর আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১৩ টন পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া ছিল ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ডিপো পর্যন্ত রপ্তানি পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া ছিল ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তবে এ ভাড়া ওঠানামা করে।

সড়কপথের তুলনায় খরচ কিছুটা কম বাড়বে নৌপথে। নৌপথে বর্তমানে দেড় থেকে দুই হাজার টনের জাহাজে জ্বালানি তেল লাগে আড়াই থেকে তিন হাজার লিটার। সে ক্ষেত্রে প্রতি লিটারে খরচ বাড়বে জাহাজভেদে ৫১ থেকে ৫৬ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান ট্রাক প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গতবার ডিজেলের দাম বাড়ানো হলেও পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়েনি। এবার ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ভারী শিল্পে বড় প্রভাব

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বেশি প্রভাব পড়বে ভারী শিল্পে। বিশেষ করে সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, সিরামিকসের মতো শিল্পের কাঁচামাল বন্দর থেকে কারখানায় নেওয়া এবং কারখানা থেকে প্রস্তুত পণ্য সারা দেশে পরিবহনের জন্য দুই দফা বাড়তি খরচ গুনতে হবে। এসব খাতে পণ্য উৎপাদনে ডিজেলের ব্যবহার হয়, সেখানেও কিছুটা খরচ বাড়বে।

একক খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল আমদানি করে সিমেন্ট খাত। আবার উৎপাদিত সিমেন্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হয়। গত অর্থবছর এ খাতে কাঁচামাল আমদানি হয় ৩ কোটি ৩৫ লাখ টন। পণ্য পরিবহন খরচ বাড়লে এ খাতে বিপুল অঙ্কের বাড়তি খরচ হবে।

সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সহসভাপতি ও কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সিমেন্ট হচ্ছে কম মূল্যের পণ্য। কম মূল্যের পণ্যে পরিবহন খরচের বেশি প্রভাব পড়ে। জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণে যাতে অযৌক্তিকভাবে ভাড়া সমন্বয় করা না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত সরকারের।

ভারী শিল্পের আরেকটি রড ও ঢেউটিন। গত অর্থবছরে এ দুটি খাতে প্রায় ৮০ লাখ টন কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। জানতে চাইলে রড উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, রড তৈরির কাঁচামাল আমদানি এবং প্রস্তুত পণ্য পরিবহনে দুই দফা বাড়তি পরিবহন খরচ যুক্ত হবে। এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে টনপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। জ্বালানির দাম বাড়ায় যৌক্তিকভাবে ভাড়া সমন্বয় করতে হবে, যাতে প্রকৃত খরচের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে না হয়।

ভোগ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাতের খরচ বাড়বে

ভোগ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পও প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করে। গত অর্থবছরে অপরিশোধিত তেল, চিনি, গম, সয়াবিন বীজ ও মসুর ডাল আমদানি হয় ১ কোটি ৩৪ লাখ টন। এসব পণ্য নৌ ও সড়কপথে কারখানায় নেওয়া হয়। আবার প্রক্রিয়াজাতের পর সড়কপথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করা হয়। দুই দফা পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ আসবে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের এখন নজর দিতে হবে যাতে পণ্য পরিবহন খরচ খুব বেশি না বাড়ে। কারণ, দিন শেষে সব পণ্যের ভোক্তা সাধারণ মানুষ। অযৌক্তিক ভাড়া বাড়ানো হলে ভোক্তাকে মাশুল গুনতে হবে।

রপ্তানিসহ অন্য খাতও দুশ্চিন্তায়

নারায়ণগঞ্জের এমডি নিট ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানা প্রতি মাসে ৪৫ থেকে ৬০টি কাভার্ড ভ্যানে প্রস্তুত করা তৈরি পোশাক চট্টগ্রাম বন্দরের ডিপোতে পাঠায়। গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রতিটি কাভার্ড ভ্যানে গড়ে ১৫ হাজার টাকা গুনতে হতো। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গতকাল শনিবারই প্রতিটি কাভার্ড ভ্যানে বাড়তি ১০ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে।

এমন তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রথম ধাক্কায় মাসে খরচ বাড়বে সাড়ে চার থেকে ছয় লাখ টাকা। এখানেই শেষ নয়। কয়েক দিনের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিরও আশঙ্কা আছে। তখন আরেক দফা খরচ বাড়বে। জ্বালানির দাম বাড়ায় নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। তাতে শ্রমিকেরা যদি মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নামেন, তখন বড় ধরনের চাপে পড়তে হবে।

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি সংযোগশিল্প প্যাকেজিং উপখাতেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদের পর থেকে লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এখন আরেক দফা খরচ বাড়বে। পরিবহনমালিকেরা রাতারাতি ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারলেও আমরা তা পারছি না। তাই লোকসান গোনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’

গাজীপুরের টঙ্গীর মাজুখানে এক্সক্লুসিভ ক্যান নামের কারখানায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধের বোতল তৈরি হয়। বর্তমানে দিনে সাত–আট ঘণ্টার লোডশেডিং হচ্ছে কারখানাটিতে। লোডশেডিংয়ের এ চাপ সামাল দিতে ব্যবহার বেড়েছে জেনারেটরের। এখন জ্বালানির দাম বাড়ায় সব মিলিয়ে দিনে খরচ হবে ৭৯ হাজার ৮০০ টাকা।

জানতে চাইলে এক্সক্লুসিভ ক্যানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির গতরাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দিন গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারব না, তত দিন বড় অঙ্কের লোকসান দিতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম এখন না বাড়ালেও হতো। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সব শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। তাতে তাঁদের প্রতিযোগিতাসক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।