২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আইএমএফের শর্ত পূরণে পিছিয়ে এনবিআর, এগিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো

গত অর্থবছরে শর্ত অনুযায়ী শুল্ক-কর আদায় করতে পারেনি এনবিআর।  ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ শুরু করেছে বিবিএস।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবন
ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে পিছিয়ে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত অর্থবছরে তারা আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী শুল্ক-কর আদায় করতে পারেনি। শুল্ক-কর ছাড় বন্ধে বাজেটে বড় কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। চলতি বছরে বাড়তি যে রাজস্ব আদায় করতে হবে, সে ব্যাপারে এখনো কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। তবে একটি শর্ত পূরণ করতে গিয়ে তাড়াহুড়া করে নতুন আয়কর চালু করা হয়েছে।

অন্যদিকে আরেক সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অনেকটাই এগিয়ে গেছে আইএমএফের শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে। বিবিএসের জন্য শর্ত ছিল আধুনিক পদ্ধতিতে ঘন ঘন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। এর অংশ হিসেবে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এবং শ্রমশক্তি জরিপ করা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি গণনায় জাতিসংঘ স্বীকৃত ‘কইকপ’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। যদিও তবে বিবিএসের তথ্য– উপাত্ত নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা প্রায়ই প্রশ্ন তোলেন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ও করা হয়েছে। আগামী নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে শর্ত কতটা পূরণ হলো, তা দেখতে আগামী মাসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, শর্ত পূরণ না হলে আইএমএফের ঋণের কিস্তি আটকে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। তবে রাজস্ব খাতে রাতারাতি সংস্কারে বড় অগ্রগতি সম্ভব নয়। ৯-১০ মাস আগে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু এই সময়ে কোনো সংস্কার হয়নি। কর খাতে সংস্কারে সরকারের আগ্রহ নেই। এনবিআর নিজে সংস্কার করবে না। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে কর ছাড় নিয়ে নেয়। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া শুল্ক-কর খাতের সংস্কার সম্ভব নয়। কসমেটিক সংস্কার দিয়ে বিপুল রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়।

এনবিআর যা করতে পারেনি

২০২২-২৩ অর্থবছরের এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। পরে আইএমএফ ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কথা বলে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল, এনবিআরের খাতায় যোগ হয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা।

কোভিড ও ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি থাকায় কাঙ্ক্ষিত হারে শুল্ক-কর আদায় সম্ভব হয়নি বলে মনে করে সরকার। তাই দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করতে পারেন অর্থমন্ত্রী।

আইএমএফের আরেকটি শর্ত হলো ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শুল্ক এবং ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থা ইউনিট গড়ে তুলতে হবে। এই ইউনিটের মাধ্যমে শুল্ক-কর আদায়ের ক্ষেত্রে আইনকানুন প্রতিপালন হচ্ছে কি না, তা দেখা হবে। আগামী মাসে আইএমএফের দ্বিতীয় পর্যালোচনার সময় বিষয়টি আলোচনায় আসবে। এই শর্ত পূরণে শুল্ক বিভাগের জন্য পৃথক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিশনারেট গঠন করা হয়েছে। কাকরাইলে ভাড়ায় চলছে কার্যালয়। তবে পুরোপুরি কার্যক্রম চলছে না বলে জানা গেছে। এখনো স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) বা কার্যপদ্ধতির নির্ধারিত মানদণ্ড এখনো ঠিক হয়নি। অন্যদিকে, ভ্যাটের ঝুঁকি ব্যবস্থা ইউনিট এখনো হয়নি।

এনবিআরকে চলতি অর্থবছর থেকে স্বাভাবিক শুল্ক-কর আদায়ের প্রবণতার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্ত হলো, জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক–কর আদায় করতে হবে। অর্থমূল্যে যা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমান। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এনবিআরকে এ জন্য একটি মধ্যমেয়াদি রাজস্ব–কৌশল ঠিক করতে হবে। এই কৌশল প্রণয়নের কাজ শেষ করতে হবে আইএমএফের তৃতীয় পর্যালোচনার আগে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালজুড়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এ জন্য এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) শামসুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আসা আইএমএফের প্রতিনিধিরা এই কৌশল প্রণয়নে সহায়তা করছে। জানা গেছে, এনবিআর প্রচেষ্টানির্ভর কৌশলে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চায়। যেমন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপের মাধ্যমে করজাল বৃদ্ধি করা, বকেয়া মামলা থেকে রাজস্ব আদায়। কিন্তু আইএমএফ চায়, অটোমেশনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হোক। এ ছাড়া যেসব খাত থেকে বেশি রাজস্ব আসে, সেখানে জোর দেওয়া। যেমন বৃহৎ করদাতা ইউনিটের পরিসর বাড়ানো।

এনবিআরের জন্য আরেকটি বড় শর্ত হলো বর্তমানে শুল্ক-করের যতটা অব্যাহতি রয়েছে, তার পরিমাণ কমাতে হবে। এনবিআর বর্তমানে বছরে গড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো কর অব্যাহতি দেয়। এর পরিমাণ কমিয়ে আনতে এনবিআর দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম নেয়নি। অবশ্য বাজেট বক্তব্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অপরিহার্য কোনো কারণ ব্যতীত আমরা কর অব্যাহতির কোনো এসআরও জারি করা পরিহার করব।’

কর অব্যাহতির পরিমাণ কতটা কমানো হলো, তা আইএমএফের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্যালোচনায় বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখা হবে।

এনবিআরের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সংস্কার নিয়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে ফলাফল পাওয়া শুরু হবে। তবে রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি নির্ভর করে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতির ওপর।

ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব শুরু

আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি গণনার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। গত সপ্তাহে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে বিবিএস। প্রথম দফায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, কোভিড শুরুর পর ২০২০ সালের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে জিডিপি ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি বা অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল।

এ বিষয়ে বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে থেকেই ত্রৈমাসিক জিডিপি গণনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে আইএমএফের শর্তে এটি জুড়ে দেওয়া হয়। ত্রৈমাসিক জিডিপি হওয়ার ফলে এখন সারা বছরের অর্থনীতির পরিস্থিতি জানা সম্ভব হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা গত কয়েক বছরের জিডিপির প্রান্তিকভিত্তিক হিসাব করে ফেলেছি। এখন থেকে আমরা প্রতি প্রান্তিকের জিডিপির হিসাব পরের প্রান্তিকে প্রকাশ করব।’

এ বছরের শুরুতেই শ্রমশক্তি জরিপেরও ত্রৈমাসিক হিসাব শুরু করেছে বিবিএস। অন্যদিকে বিবিএস এপ্রিল মাস থেকে মূল্যস্ফীতি গণনায় জাতিসংঘের ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অব ইনডিভিজ্যুয়াল কনজাম্পশন অ্যাকর্ডিং পারপাস’ বা কইকপ পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এই পদ্ধতিতে ৭২২টি পণ্য ও সেবা দিয়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে।