বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪০ টাকা পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এই খরচ জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধপত্র কিনতেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত দুই দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার এক অধিবেশনে উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে ক্যানসারের রোগীর খরচের এই চিত্র তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি করেন বিআইডিএসের গবেষক আবদুর রাজ্জাক সরকার। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
গবেষণায় দেখানো হয়, হাসপাতালে নিবন্ধন, চিকিৎসক সম্মানী, পরীক্ষা–নিরীক্ষাসহ সরাসরি চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত খরচ হয় গড়ে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৯৫ টাকা। যাতায়াত, খাবারসহ অন্যান্য খরচ হয় আরও ৯০ হাজার ৭৪৫ টাকা। ক্যানসারের প্রথম স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৪৩ টাকা। আর দ্বিতীয় স্তরে গড় খরচ ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা।
সাড়ে চার শ ক্যানসার রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এই গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পরিবারের কোনো সদস্য ক্যানসারে আক্রান্ত হলে প্রায় ৭৮ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করতে হয়। ৬৫ শতাংশ পরিবার নিয়মিত আয় থেকে খরচ করেছে। ৫৬ শতাংশ পরিবারকে চিকিৎসার জন্য সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। আর সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে ৪০ শতাংশ পরিবারকে। গবেষণায় একটি জতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করা হয়।
বিআইডিএসের গবেষক আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, কারও ক্যানসার হলে একটি পরিবারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। এতে বহু পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়।
ক্যানসারবিষয়ক গবেষণার তথ্য উপস্থাপন নিয়ে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ১৩-১৪ শতাংশ পরিবার ক্যানসারের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। তাই ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় একটি সরকারি তহবিল গঠন করা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০ টাকা করে নেওয়া যেতে পারে। এভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল হতে পারে। সেখান থেকে ক্যানসার রোগীকে প্রয়োজন অনুযায়ী পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া যাবে।
অধিবেশনে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন ও গবেষক আবদুর রাজ্জাকের আরেকটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। উৎপাদনমুখী কাজে নারীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারের ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে এই গবেষণাটি করা হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে, কোভিডের সময় যেসব নারী স্বপ্ন প্রকল্পের আওতায় ছিলেন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোভিডের সময় স্বপ্ন প্রকল্পের আওতায় থাকা নারীদের মাত্র ১৯ শতাংশ জীবিকার হুমকিতে পড়েন। আর স্বপ্ন প্রকল্পের বাইরে থাকা নারীদের প্রায় ৩৩ শতাংশ জীবিকার সংকটে ছিল।
এ বিষয়ে বিনায়ক সেন বলেন, স্বপ্ন কর্মসূচির মাধ্যমে একজন নারীর পেছনে ৫৮ হাজার টাকা খরচ করে ৮৪ হাজার টাকার সুবিধা মিলেছে। তাই এ ধরনের কর্মসূচি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
উল্লেখ্য, স্বপ্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। কিছু নগদ অর্থও দেওয়া হয়।
পোশাক খাতে চার ঘাটতি
তৈরি পোশাক কারখানায় মোটাদাগে চার জায়গায় দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এগুলো হলো সেলাই মেশিন অপারেটর, মান পরিদর্শক ও নিয়ন্ত্রক, প্রিন্টিং মেশিন অপারেটর এবং এমব্রয়ডারি মেশিন অপারেটর। এই চার শ্রেণিতে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশের মতো দক্ষতার ঘাটতি আছে। সম্মেলনের শেষ দিনের প্রথম অধিবেশনে তৈরি পোশাক খাতের দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে করা গবেষণার ভিত্তিতে এ কথা বলা হয়। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএস গবেষক রিজওয়ানা ইসলাম। ১১৯টি নিট ও ওভেন কারখানার ওপর এ গবেষণা করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন পর্যায়ে তুলনামূলক দক্ষতার ঘাটতি কম। কিন্তু ব্যবস্থাপক পর্যায়ে ঘাটতি বেশি। পোশাক কারখানার মালিকেরা যে ধরনের কর্মী চান, সে ধরনের লোক পাওয়া যায় না।
অধিবেশনটিতে বিভিন্ন খাতের দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে আলোচনা হয়। সভাপতিত্ব করেন স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের উপনির্বাহী প্রকল্প পরিচালক সানোয়ার জাহান চৌধুরী। বিশেষ আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক শুভাশীষ বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক প্রমুখ।
ওই অধিবেশনে আরও তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। তার একটি ছিল হালকা প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিক খাত নিয়ে। গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এই দুই খাতে কর্মরত চার ভাগের তিন ভাগ শ্রমিকের কাজের সঙ্গে পড়াশোনার মিল নেই। খাত দুটি নিয়ে গবেষণা করেছেন বিআইডিএসের গবেষক কাজী ইকবাল ও মারুফ আহমেদ।
বিআইডিএসের আরেক গবেষক হারুনুর রশিদ চামড়া ও পাদুকা খাত নিয়ে তাঁর উপস্থাপনা তুলে ধরেন। সেখানে বলা হয়, এই খাতের ৫০ শতাংশের বেশি কর্মী জানিয়েছেন তাঁরা কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব বোধ করেন।
কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত নিয়ে অপর গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষক কাশফি রায়ান। তিনি বলেন, গবেষণাকালে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের ৪৭ শতাংশ শ্রমিকের দক্ষতার ঘাটতি আছে। তাই খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজন।