দেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাংকেরও ভূমিকা আছে: রেহমান সোবহান

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান

কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান দেয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের জন্য খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে স্থান পায় না। এই খেলাপি ঋণের বাড়বাড়ন্তের মধ্য দিয়ে দেশে বৈষম্য বাড়ছে।

‘ইজ বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল’ বা ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের আপাত স্ববিরোধ কি টেকসই’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গতকাল অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে গতকাল এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে সানেম। বইটি সম্পাদনা করেছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ফ্রাসোঁয়া বুরগিওনন ও উমর সালাম। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এটি প্রকাশ হয়েছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেশে খেলাপি ঋণের জনক হিসেবে আখ্যা দেন রেহমান সোবহান। বলেন, ওই সময় বিশ্বব্যাংকও খেলাপি ঋণ তৈরিতে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

তাদের পরামর্শেই ওই সময় বেসরকারি খাতের উন্নয়নে বিপুল ঋণ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু ব্যাংকের ব্যালান্স শিটের দিকে তাকানো হয়নি। শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থার মাধ্যমে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এরপর তাদের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে বিশ্বব্যাংক একটি কথাও বলেনি, যদিও পরবর্তীকালে তারাই খেলাপি ঋণের বিষয়ে সোচ্চার।

অনেকে সেই ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঋণ পুনঃ তফসিলের সুবিধা পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র এক শ্রেণির মানুষকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে; অর্থাৎ আয় বণ্টনে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে। সেই সঙ্গে এরা কর ছাড়সহ নানা ধরনের ছাড় পেয়েছে। এই ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দেন এই অর্থনীতিবিদ। তাঁর মতে, এটা অংশত নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা।

দেশে নিয়মনীতির ভিত্তিতে কিছু হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন রেহমান সোবহান। তাঁর মতে, মুখ দেখে দেখে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। সে কারণে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না যে দেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে।

রেহমান সোবহানের অভিযোগ, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ফলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে গবেষকদের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন সিপিডি চেয়ারম্যান। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক থাকার সময় আখতার মাহমুদকে শিল্প ব্যাংককে পাঠান খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য বের করতে। তখন তিনি কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বেরিয়েছেন।

তিনি (আখতার মাহমুদ) গিয়ে দেখেন, শিল্প ব্যাংকে খেলাপি ঋণের খাতাই নেই। এরপর তাঁকে ব্যাংকের গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়। গুদামে ঘর্মক্লান্ত হয়ে তিনি ৪০০ ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেন, যত ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই খেলাপি।

রেহমান সোবহান মনে করেন, এখন খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য বের করতে এভাবে মাঠে নামতে হবে।

ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের ব্যালান্সশিটের তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে, প্রকৃত অর্থে খেলাপি ঋণ কতটা।

‘ইজ বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল’ বইয়ের অন্যতম সম্পাদক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল এই বই। বইয়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, বইটির প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, অংশীজনের জরিপ, প্রাথমিক শিক্ষা, রপ্তানি বৈচিত্র্য, ব্যাংকিং খাত ও ভূমি প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে যেসব বিষয় এখন পর্যন্ত অবদান রেখেছে, সেগুলো উন্নয়নের পরের ধাপে যেতে অবদান রাখতে পারবে না। এ ধরনের উন্নয়ন টেকসই নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম; সরকার অর্থসংকটে আছে। এ ছাড়া দেশে সংস্কারবিরোধী গোষ্ঠী খুবই শক্তিশালী; এরা দুর্নীতির চক্র ভাঙতে বাধা দেয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। আরও বক্তৃতা দেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মীর্জা এম হাসান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার, যুক্তরাজ্যের আলস্টার ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক এস আর ওসমানী প্রমুখ।