দেশে একক ভ্যাট হার ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা জরুরি। বাংলাদেশের মতো দেশে এত বেশি হারে (১৫ শতাংশ) ভ্যাট থাকা উচিত নয়। কারণ, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের রেয়াত নিতে পারে না। তাই ভ্যাট হার বাস্তবসম্মত করা উচিত।
আজ বুধবার ঢাকায় এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এই প্রস্তাব দেন এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া। বর্তমানে ভ্যাট আইনে একাধিক হারে ভ্যাট রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই অনুষ্ঠানে খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও একক ভ্যাট হারের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, একক ভ্যাট হার (১০-১৫ শতাংশ) হলে কি বড় অসুবিধা হবে? মূল্য সংযোজনের ওপর ১০–১৫ শতাংশ ভ্যাট খুব বেশি না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ ও এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেড রাজধানীর এক হোটেলে এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিবিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, আগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা ছিল ভগবানের দয়ার মতো। তিনি আরও বলেন, আয় না হলেও এ দেশে প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হয়। উৎসে করের বিষয়টি পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ, এখানে অনেক অন্যায্য কর আদায় করা হয়। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) কথা শুনলেই ভয় হয়। সেখানে শুধু হয়রানি হয়।
আইএমএফ ‘ইনক্রেডিবল’ লক্ষ্য দিয়েছে
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানান, তিনি আজ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সংস্থাটি রাজস্ব আদায়ে ‘ইনক্রেডিবল’ (অবিশ্বাস্য), কিন্তু অসম্ভব নয় এমন লক্ষ্য দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রচণ্ড চাপ দিয়েছে। এ ছাড়া সংস্থাটি বিভিন্ন খাতে করছাড় কমানোর কথা বলেছে।
আবদুর রহমান খান আরও বলেন, করছাড় কমাতেই হবে। তা না হলে ঋণের বোঝা বাড়বে। একসময় ঋণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
কর সংস্কারে ১১ সুপারিশ
এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি ১১টি সংস্কারের প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো কর প্রশাসন ও নীতি বিভাগ আলাদা করা; বাজেট কার্যক্রম গতিশীল ও কার্যকর করে তোলা; অটোমেশন; অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার ছোট করে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার বড় করা; একক মূসকহার নির্ধারণ ও বর্তমান আইনের পুনর্মূল্যায়ন; স্তরভিত্তিক আমদানি শুল্ক নির্ধারণ এবং দেশীয় উৎপাদনকারীদের জন্য সর্বনিম্ন আমদানি শুল্ক চালু ইত্যাদি।
স্নেহাশীষ বড়ুয়া মনে করেন, কোম্পানিগুলো তাদের দখলে থাকা বাজার অংশীদারত্ব অনুসারে কর দিচ্ছে না। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেসব কোম্পানির বাজার অংশীদারত্ব ৪০ শতাংশ, তারা রাজস্ব দেয় ওই খাতের মোট রাজস্বের ৭০ শতাংশ। আর যেসব কোম্পানির বাজার অংশীদারত্ব ৬০ শতাংশ, তাদের কাছ থেকে ওই খাতের মাত্র ৩০ শতাংশ কর আসে। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ওই নির্দিষ্ট খাত থেকে ৭০-৭৫ শতাংশ রাজস্ব হারায়।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ আরেকটি মূল বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, করবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হলে বিনিয়োগ বাড়বে। গবেষণায় দেখা গেছে, করহার ১ শতাংশ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ সাড়ে ৩ শতাংশ কমে। আবার করভার ২০ শতাংশ কমালে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ১৪ গুণ এবং রাজস্ব আয় ছয় গুণের বেশি বাড়ে। তাই শুল্ক-কর খাতে সংস্কার প্রয়োজন।
বড় করদাতারা যা বলেন
ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করের (মূসক) হার ১০ শতাংশ করার পক্ষে মত দেন বিএসআরএমের চেয়ারম্যান আলীহোসেন আকবর আলী। তাঁর মতে, ভ্যাট হার কমালে বহু মানুষ ভ্যাট দিতে আগ্রহী হবেন। তিনি আরও বলেন, কর রেয়াত পেতে আবেদন করলে কর কর্মকর্তারা হয়রানি করেন। তিনি দাবি করেন, সাত বছর ধরে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর রেয়াতের সাড়ে চার শ কোটি টাকা আটকে আছে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, তৈরি পোশাক খাতের ঝুট পুড়িয়ে ফেললে খরচ কম, কর দিতে হয় না। কিন্তু ঝুট বিক্রি করতে গেলে ভ্যাট দিতে হয়। এতে কারখানা মালিকের খরচ বাড়ে।
নেস্লে বাংলাদেশের হেড অব লিগ্যাল দেবব্রত রায় চৌধুরী বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা হয়তো ২৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করলাম। তখনকর করহার দেখেই বিনিয়োগ পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু দুই বছর পর করহার পরিবর্তন হওয়ায় আমাদের পরবর্তী বিনিয়োগ বাদ দিতে হয়েছে। এতে কর্মসংস্থান ও রাজস্বে ক্ষতি হয়েছে।’
লাফার্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইকবাল চৌধুরী মনে করেন, রাজস্ব–সংক্রান্ত আপিলাত ট্রাইব্যুনাল নিজেই রাজস্ব আদায়কারী হয়ে গেছে। তারা যেন রাজস্ব আদায় করার পক্ষে কথা বলে। তিনি আরও বলেন, কর কর্মকর্তারা মনে করেন, ‘আমরা কর ফাঁকি দিতে এসেছি। এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।’
ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সৈয়দ আবদুল মোমেন বলেন, সব দেশই নতুন উদ্যোক্তাদের কর অবকাশ সুবিধা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা নেই।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের পরিচালক জেরিন মাহমুদ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা প্রমুখ।