বাজেটের পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কমবে না

চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো যাবে না। এ জন্য রাজস্ব নীতিও প্রয়োগ করতে হবে।

আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রী নির্ধারণ করেছেন, তা অর্জিত হবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, বাজেটে ঘোষণা করা এ লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, সে ব্যাপারে পর্যালোচনা তুলে ধরেন ফাহমিদা খাতুন। আজ শুক্রবার সিপিডির বাজেটোত্তর এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি)।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতির যে হিসাব করা হয়, সেটি গড় হিসাব। শুধু সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্য বাস্কেটের ভিত্তিতে হিসাব করা হলে মূল্যস্ফীতি আসলে ২০ শতাংশের বেশি।

সিপিডির মূল্যায়ন, বাজেটে দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়, মূল্যস্ফীতির যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ, এসব লক্ষ্য অর্জনের যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। ফলে ঘোষিত বাজেট দিয়ে অর্থনীতির চলমান সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।

প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভের ক্ষয়রোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই, আছে কিছু বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা। ফলে ঘোষিত বাজেট নিয়ে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ

বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে সিপিডি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এই সুবিধা নৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া এই ধরনের ব্যবস্থা সামাজিক ন্যায্যতার দিক থেকেও বৈষম্যমূলক।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, এবারে সর্বোচ্চ করহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু ১৫ শতাংশ কর দিয়েই কালোটাকা বৈধ করা যাবে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে কর ফাঁকিবাজদের প্রণোদনা আর নিয়মিত ও সৎ করদাতাদের তিরস্কৃত করা হয়েছে।

অন্যদিকে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্বৃত্তায়ন, ঋণখেলাপি ও করখেলাপিদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার কথা বলা হয়েছে। বাজেটে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেটি নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, ‘সরকারকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে দুষ্টচক্রকে মাথায় হাত বুলিয়ে বা সুবিধা দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার পথে যাব, নাকি নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ এদের বিরুদ্ধে যে জিহাদের কথা বলেছে, সেই পথে যাব। আমরা এখনো আশা করি সরকার শেষ পর্যন্ত কালোটাকা সাদা করার এ ব্যবস্থা থেকে সরে আসবে।’

মোস্তাফিজুর রহমান প্রশ্ন রাখেন, ‘এবারের বাজেটে বলা হয়েছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ যাঁরা নেবেন, সরকারের কোনো সংস্থা তাঁদের কোনো প্রশ্ন করবে না। এর মাধ্যমে আমরা তাহলে কী বার্তা দিলাম।’

এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অতীতেও আমরা দেখেছি এ ধরনের সুবিধা দিয়ে খুব বেশি লাভ হয় না। খুব বেশি টাকা সাদা হয় না। বরং তা কালোটাকার মালিকদের জন্য প্রণোদনামূলক।’

লক্ষ্যমাত্রা যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী

সিপিডি মনে করে, ঘোষিত বাজেটটি নতুন একটি সরকারের পুরোনো বাজেট। সংস্থাটি বলেছে, নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী বাজেটে কোনো মুনশিয়ানা দেখাতে পারেননি।

বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা, জিডিপির তুলনায় মোট বিনিয়োগ ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশে ও বেসরকারি বিনিয়োগ ২৭ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করা, টাকার মান বৃদ্ধি করে ডলারের দাম ১১৪ টাকায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে সিপিডি বলেছে, যদি জিডিপির তুলনায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২৭ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করতে হয়, তাহলে অতিরিক্ত প্রায় ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ শতাংশ। আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। একদিকে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানোর পরিকল্পনা হয়েছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে কি

আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। কিন্তু সিপিডি বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে এনবিআরের রাজস্ব আদায় দাঁড়াবে সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগামী বছর এনবিআরকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে এনবিআরকে নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের বাইরে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে। এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দিয়ে যা অর্জন করা সম্ভব নয়।

রাজস্ব পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমাদের রাজস্ব নীতিও এখন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, রাজস্ব আদায়ে এনবিআর প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে। এ জন্য পরোক্ষ কর যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তার বিপরীতে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর চেষ্টা ছিল কম।

ভালো দিক

এবারের বাজেটে বেশ কিছু পণ্যের কর ও ভ্যাট কমানো হয়েছে। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সিপিডি বলেছে, এর সুবিধা ভোক্তা পর্যায়ে কতটা মিলবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।

বাজেটের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনার পাশাপাশি কিছু পদক্ষেপের প্রশংসাও করেছে সংস্থাটি। তারা বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে দরকার ছিল সংযত বাজেট। সেই চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী, এটা ভালো দিক। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের দিক থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত শীর্ষ পাঁচে ঢুকেছে। এটিও ইতিবাচক দিক। দেশীয় শিল্প বিকাশে সহায়তা দেওয়া এবং বিদ্যুৎ খাতের সঞ্চালন ও বিতরণে বরাদ্দ বাড়ানো আমরা সমর্থন করি।