সংকট জ্বালানিতে, গুরুত্ব বিদ্যুৎ খাতে

এবার (২০২৪-২৫) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত মিলে ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। এতে বলা হয়, উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিদ্যুৎ। তবে আগের বছরের তুলনায় এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কমেছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে চলমান জ্বালানি–সংকটের মধ্যেও এবার বরাদ্দে অনেকটা পিছিয়ে আছে জ্বালানি খাত। এ খাতে এবার ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। আর বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।

জ্বালানির অভাবে মানুষ লোডশেডিংয়ে ভোগে। তবু এ খাতে বরাদ্দ বাড়ে না। তার মানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। শুধু উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর নামে ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে চায়।
এম শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত মিলে ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।

দেশে কয়েক বছর ধরে জ্বালানি–সংকট চলছে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমতে থাকায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। এবারের বাজেট প্রস্তাবেও এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আমদানির ঝোঁক কমিয়ে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জ্বালানি খাতে এবার ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও বিদায়ী অর্থবছরে ৯৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ–সুবিধার আওতায় এসেছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও জ্বালানির অভাবে গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয়। আর বিদ্যুৎ–ঘাটতি মেটাতে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে থাকে। অথচ প্রতিবার বাজেটে উপেক্ষিত থাকে জ্বালানি খাত।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোয় আগামী কয়েক বছর বরাদ্দ রাখার দরকার নেই। সঞ্চালন ও বিতরণে থাকতে পারে। নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোয় বরাদ্দ দরকার। কূপ খননের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার, তার জন্যও তো টাকা লাগবে। জ্বালানিতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোয় আগামী কয়েক বছর বরাদ্দ রাখার দরকার নেই। সঞ্চালন ও বিতরণে থাকতে পারে। নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোয় বরাদ্দ দরকার। কূপ খননের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার, তার জন্যও তো টাকা লাগবে। জ্বালানিতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল।
ম. তামিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী

বিদায়ী বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি কমে হয় ২৭ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এবার এ খাতে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চায় সরকার। ২০৪১ সালের মধ্যে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়ন ও ব্যবহার উৎসাহিত করতে ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সামুদ্রিক সম্পদের আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে। এখান থেকে দিনে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা আছে। একই এলাকায় ৬০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার আরেকটি টার্মিনাল স্থাপনের কাজ চলছে। এর পাশাপাশি পটুয়াখালীর পায়রায় ৫০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার একটি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ চলছে। এর বাইরে স্থলভাগে ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জ্বালানি তেলের মজুতক্ষমতা ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৬০ দিনে উন্নীত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বছরে জ্বালানি তেলের পরিশোধনক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করতে ইআরএল-২ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় জানানো হয়, ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার আশা করছে সরকার। বর্তমানে দেশে ৯ হাজার ১৪৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট ও ১টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আরও ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে।

জ্বালানি–সংকটের মধ্যেও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কমার সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়া দরকার। সরকার একাধিক প্রকল্প নেওয়ার কথা বলেছে। আগে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে টাকা নিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান করা হতো। এলএনজি আমদানিতে খরচ করে এখন সেই তহবিল অনেকটা ফাঁকা। তাই জ্বালানি খাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানির অভাবে মানুষ লোডশেডিংয়ে ভোগে। তবু এ খাতে বরাদ্দ বাড়ে না। তার মানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সরকারের উদ্দেশ্য নয়। শুধু উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর নামে ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে চায় তারা। আর অব্যবহৃত সক্ষমতার খরচের দায় ভোক্তার ওপর চাপাবে। তবু সরকার জ্বালানিতে বিনিয়োগ করতে চায় না।