একে অপরকে দোষারোপে ব্যবসায়ীরা

দাম নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো। রোজায় বাজার স্থিতিশীল থাকবে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গোলাম মাওলা

নিত্যপণ্যের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি কেন, তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুললেন। এ নিয়ে বচসাও হলো। তবে আগামী পবিত্র রমজানে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় ও স্থিতিশীল থাকবে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেল না।

পণ্যের আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে একে অপরকে দোষারোপের এ ঘটনা ঘটে। আসন্ন রমজান উপলক্ষে গতকাল রোববার ঢাকার মতিঝিলে নিজেদের কার্যালয়ে সভাটি আয়োজন করে এফবিসিসিআই।

মিলগুলো আমাদের রসিদ দিচ্ছে এক দরে, আর টাকা নিচ্ছে অন্য দরে।
গোলাম মাওলা, পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী
বিশ্বজিৎ সাহা

সভায় ব্যবসায়ীরা কিছু কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। একটি হলো, পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও তা নিষ্পত্তিতে সমস্যা হচ্ছে। মানে হলো, ব্যাংকে মার্কিন ডলারের অভাবে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। আরেকটি সমস্যা হলো গ্যাসের অভাবে শিল্পে উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। সমস্যাটি আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়তে পারে।

এফবিসিসিআই প্রতিবছর রোজার আগে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে এমন একটি সভা আয়োজন করে। সভার ফলাফল কী হয়, তা ফুটে উঠেছে সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের মুখেই। তিনি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গত বছর রোজার আগে আমরা বিষয়টি নিয়ে সভা করছিলাম। তারপরও দাম বেড়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘অন্তত এ বছর রমজানে দাম বাড়ানো হবে না, এই অভ্যাসটা শুরু করি। বরং পারলে দাম কিছুটা কমাব। রমজান এলে দাম বাড়ে, এই বদনাম থেকে বের হতে চাই।’

যিনি রসিদ পান না, তিনি তো পণ্যই নেন না। কারণ, রসিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি হয় না।
বিশ্বজিৎ সাহা পরিচালক, সিটি গ্রুপ
জসিম উদ্দিন
আরও পড়ুন

বচসা, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়

এফবিসিসিআই এমন একটি সময়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সভাটি আয়োজন করল, যখন বাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। সরকার কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা–ও মানা হয় না। যেমন চিনি। সরকার নির্ধারিত দর প্রতি কেজি ১০৭ টাকা, বাজারে বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি।

এফবিসিসিআইয়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভোজ্যতেল ও চিনি উৎপাদনকারী কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির কর্মকর্তারা। আরও ছিলেন পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। দাম নিয়ে এই দুই পক্ষের মধ্যেই বচসা হয়।

বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, ‘চিনির দাম কীভাবে নির্ধারণ করা হয়, পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে তা আমরা জানি না। আবার সরকার নির্ধারিত মূল্যে আমরা মিল থেকে কিনতেও পারি না।’

রসিদ নিয়ে এসব নাটক–সিনেমা বন্ধ করেন।
জসিম উদ্দিন সভাপতি, এফবিসিসিআই

পাইকারি ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগের বিষয়ে মিলগুলোর কাছে জানতে চান এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন। তখন দেশের শীর্ষস্থানীয় নিত্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, যাঁরা পণ্য কেনেন, তাঁরা রসিদ পান। যিনি রসিদ পান না, তিনি তো পণ্যই নেন না। কারণ, রসিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি হয় না।

এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘মিলগুলো আমাদের রসিদ দিচ্ছে এক দরে, আর টাকা নিচ্ছে অন্য দরে। এসব সত্য কথা বলার জন্য আবার আমাদেরকে মিলগেটে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

এ সময় বিষয়টি নিয়ে উৎপাদনকারী ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। মিলগুলোর প্রতিনিধিরা রসিদ না পেলে পণ্য না কেনার জন্য বলেন। এর উত্তরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রশ্নটা রসিদ পাওয়া নিয়ে নয়, নির্ধারিত দামে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

* ডলার–সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হওয়ার কথাও বললেন ব্যবসায়ীরা। * গ্যাস–সংকটের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার কথাও ওঠে। * ডিম, মুরগি ও মাংসের দাম ব্যাপকভাবে বাড়লেও তা নিয়ে আলোচনা হয়নি।

ব্যবসায়ীদের মধ্যে যখন বচসা চলছিল, তখন কথা বলা শুরু করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পণ্য কেনাবেচার সময় রসিদ না দেওয়া, কিংবা এক দামের রসিদ দিয়ে অন্য দাম নেওয়া—এগুলো ব্যবসার কালো অধ্যায়। লাভ করবেন আর কাগজ দেবেন না, এটা হবে না। অল্প কিছু ব্যবসায়ীর এমন আচরণের কারণে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের দুর্নাম হয়।’

এর আগে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন থেকেই ব্লেম গেম (দোষারোপের খেলা) শুনতেছি। ওমুকে রসিদ দেয় না। আরে ভাই, আমরা কী অবৈধ ব্যবসায়ী নাকি? ইয়াবার ব্যবসা করি নাকি?’ তিনি বলেন, ‘খুচরা বিক্রেতারা বলেন পাইকারি থেকে রিসিট পান না, পাইকার বলে উৎপাদক থেকে রিসিট পাই না। উৎপাদকেরা বলেন তাঁরা রিসিট দেন। রসিদ নিয়ে এসব নাটক–সিনেমা বন্ধ করেন।’

বিষয়টি নিয়ে এফবিসিসিআই একটি কমিটি গঠন করে কাজ করবে বলে সভায় ঘোষণা দেন জসিম উদ্দিন।

আরও পড়ুন

ডলার–সংকট, গ্যাসের অভাব

সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যবসায়ীরা বলে আসছিলেন, এ কারণে নিত্যপণ্যের আমদানিতেও সংকট তৈরি হয়েছে। রোজার বাজার সামনে রেখে আমদানির ঋণপত্র খোলা কম হয়েছিল। গত মাস জানুয়ারিতে তা বাড়ে। তবে ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন, ঋণপত্র খোলা গেলেও এখন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই।

উল্লেখ্য, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৬৩ কোটি ডলারে (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন), যা ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

আমদানিতে সমস্যার বিষয়টি উঠে আসে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য কী পরিমাণ এলসি (ঋণপত্র) খুলতে হবে, তা আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দিয়েছি। এলসি হচ্ছে, তবে সেটেলমেন্ট (নিষ্পত্তি) হচ্ছে না। জাহাজ এসে আউটার বন্দরে পড়ে আছে। তিনি বলেন, সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো হলে এবং সরকার করভার কমালে চিনির দাম কমবে।

উল্লেখ্য, পণ্য আমদানির পর খালাস হলে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়। গত মাসে দেখা গেছে, কয়েকটি জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে এলেও ব্যাংক ডলারের ব্যবস্থা না করতে পারায় পণ্য খালাসে দেরি হয়েছে।

নিত্যপণ্য সরবরাহকারী আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, গ্যাসের সমস্যার কারণে চার মাস ধরে চিনি উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে। গ্যাসের সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। এটা সমাধান হলে বাজার স্থিতিশীল হবে।

‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে’

সভায় সরকারি সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান।

সফিকুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছে কথা বলে জানা গেছে, রমজান ও পরবর্তী এক–দুই মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ রয়েছে। সুতরাং সরবরাহ ঘাটতির কারণে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা নেই। বেশি দাম নিলে ও পাকা রসিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

অবশ্য ব্যবস্থা নেওয়ার এই আশ্বাসে আশ্বস্ত নয় ক্রেতাদের অনেকে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দর নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা। বাজারে এর চেয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে সবার চোখের সামনে। রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি সিলিন্ডার কিনতে ৩০০ টাকা বাড়তি দিতে গিয়ে অসহায় লাগে। চোখের সামনে এসব চললেও সরকারি সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখতে পারছে না।’

এদিকে বাজারে গত দুই সপ্তাহে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ডিম, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম। যে ব্রয়লার মুরগি ১৫০ টাকার আশপাশে ছিল, তা ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের সভায় এসব নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।