গত বছর টুইটারের মালিকানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রতিষ্ঠানটির বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেন ইলন মাস্ক। তিনি মূলত নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এই ছাঁটাই করেন। এরপরের কাহিনি ভিন্ন।
টুইটারের পর একে একে মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেটাও ব্যাপকহারে কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। গত বুধবার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয় করোনাকালে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পাওয়া অনলাইনে বৈঠক করার জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম জুম। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ডিজনি। সাত হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডিজনির প্রধান নির্বাহী বব আইগার।
চলতি বছরের শুরু থেকে যেন বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাইয়ের মচ্ছব শুরু হয়েছে। জানুয়ারি মাসের ভারতীয় গণমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারিতে গড়ে প্রতিদিন তিন হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে প্রযুক্তি খাতে। বৈশ্বিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সব মিলিয়ে প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলো থেকে প্রায় দেড় লাখ কর্মী ছাঁটাই করা হয়।
মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে গুগল—এমন কোনো কোম্পানি বাদ নেই, যারা এ ছাঁটাই করেনি। ছাঁটাইয়ের কারণ হিসেবে প্রযুক্তি খাত বিশ্লেষকেরা দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, করোনা মহামারিতে লকডাউনের সময় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিপুল কর্মী নিয়োগ দেওয়া, যাঁদের এখন আর প্রয়োজন হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ।
শুধু প্রযুক্তি কোম্পানি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের বড় ব্যাংকগুলোও কর্মীদের দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে। ওয়েলস ফারগো বন্ধকি ঋণ বিভাগের কয়েক শ কর্মী ছাঁটাই করেছে বলে জানা গেছে। নভেম্বর মাসে বার্কলে প্রায় ২০০ কর্মী ছাঁটাই করেছিল। ওয়াল স্ট্রিটের মহিরুহ হিসেবে পরিচিত গোল্ডম্যান স্যাকস ও সিটি গ্রুপও কর্মী ছাঁটাই করেছে।
কর্মীর আধিক্য ও মহামারির প্রভাব
মহামারির সময় বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘরে থেকে কাজ করেছেন। ফলে প্রযুক্তির চাহিদা হঠাৎ করে বহুগুণ বেড়ে যায় তখন। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বিপুল কর্মী নিয়োগ দিয়েছে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। তখন তাদের মুনাফাও হয়েছে বিপুল। কিন্তু এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় কর্মীদের বিদায় করা হচ্ছে।
ঋণমান নির্ণয়কারী যুক্তরাষ্ট্রভিক্তিক সংস্থা ফিচ রেটিংসের মার্কিন আঞ্চলিক অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ওলু সিনোলা সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের হার মহামারির আগের সময়ের তুলনায় এখনো ৮ শতাংশ বেশি। এর অর্থ হলো, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রযুক্তি খাতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে ২০২২ সালে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেড়ে যায়। একপর্যায়ে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায় মূল্যস্ফীতি, তা মোকাবিলায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ গত বছর থেকে এ পর্যন্ত মোট আটবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর পরিচালন ব্যয় বেড়েছে; অন্যদিকে, নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ঋণের সুদহারও বেড়ে গেছে। এতে অন্যান্য খাতের মতো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর পক্ষেও ঋণ নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লড়াই
কয়েক দিন আগেই খবর এল, তুমুল জনপ্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত চ্যাটবট চ্যাটজিপিটিতে মাইক্রোসফট এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এটাই প্রথম নয়, এর আগেও তারা সেখানে বিনিয়োগ করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এই চ্যাটজিপিটি গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবসা ধসিয়ে দেবে।
তবে গুগলও বসে নেই, তারাও সম্প্রতি বার্ড নামে পরীক্ষামূলক একটি চ্যাটবট নিয়ে এসেছে। কিন্তু বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, একটি প্রচারণামূলক ভিডিওতে গুগলের নতুন চ্যাটবট ‘বার্ড’কে একটি সহজ প্রশ্ন করা হলে তা ভুল উত্তর দেয়। এতে গুগলের প্রচারণা ব্যর্থ হয় এবং তারা রাতারাতি পুঁজিবাজারে ১০০ বিলিয়ন ডলার হারায়।
এ দুই উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, তা তুলে ধরা। ব্যবসা বিশ্লেষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিবি ইনসাইটের তথ্যানুসারে, এআইভিত্তিক স্টার্টআপগুলো গত বছর ৩০ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬০ কোটি ডলার অর্থায়ন পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে স্বাস্থ্য খাত ও ফিনটেকে।
বাস্তবতা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চেনা পৃথিবী বদলে দিচ্ছে। চ্যাটজিপিটির কারণে কপি রাইটিং ও বিজ্ঞাপনের জগতে কাজ করা অনেক মানুষের কাজ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন যাঁরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে গ্রাফিকসসহ নানা ধরনের কাজ করছেন, তাঁরাও চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন।
ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে নিজেদের অংশীদারি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো উঠেপড়ে লেগেছে। এই লড়াই আগামী দিনে আরও তীব্র হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাতে আরও অনেক কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। আবার অনেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেও অনেক মানুষের কাজ কেড়ে নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মাথাভারী ব্যবস্থাপনা
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিবিষয়ক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট অবশ্য এই উচ্চ বেতনের শোভন কাজ করা কর্মীদের ছাঁটাইয়ের পেছনে ভিন্ন গল্প হাজির করেছে। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এমনিতেই যথেষ্ট মাথাভারী। ফলে সেখানে কাঁচি চালানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক কর্মসংস্থানের ৪৪ শতাংশ ব্যবস্থাপক ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদারদের দিয়ে পরিপূর্ণ, যা ২০০০ সালে ছিল ৩৪ শতাংশ। এর অর্থ হলো প্রযুক্তি ও আর্থিক খাতের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। সে জন্য এ ধরনের উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদারদের প্রয়োজন হয়েছে। তথ্যানুসারে, দেশটির উৎপাদন খাতে উঁচু পদে কর্মীর অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ, ২০০২ সালে যা ছিল ২৯ শতাংশ। খুচরা বিক্রয় খাতে এই হার দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ, দুই দশক আগে যা ছিল ১২ শতাংশ। অটোমেশন ও অফশোরিং বা আউটসোর্সিংয়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে কারিগরি কাজ করা কর্মী ও হিসাবরক্ষকের প্রয়োজনীয়তা কমেছে, সে জায়গায় ব্যবসা বিশ্লেষক ও সিস্টেম–বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বেড়েছে।
মাথাভারী ব্যবস্থাপনার কারণে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা এখন বিপাকে পড়েছেন। কিন্তু তাই বলে এ কথা বলা নিঃসন্দেহে অত্যুক্তি হবে যে, শোভন কাজের জগতে মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। ডেস্কভিত্তিক কাজের অভাব নেই। আর্থিক খাতে পে–রোলে থাকা কর্মীর সংখ্যা প্রাক্–মহামারি পর্যায়ের সমান। আর সামগ্রিকভাবে প্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা ২০২০ সালের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি।
এই যুগের নীতি হলো, কমসংখ্যক মানুষ দিয়ে বেশি কাজ করানো। ফলে দক্ষ প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও প্রোগ্রামারদের সুসময় কেবল শুরু হচ্ছে বলেই মনে করে দ্য ইকোনমিস্ট। অর্থাৎ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা ও বেতন বাড়বে। তবে নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা কমবে। সামনে এ ধরনের কর্মীদেরই বিপদ।