ফিরে দেখা ২০২৪
বিনিয়োগ ও চাকরির জন্য বছরটি ভালো ছিল না
বছরজুড়ে রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মোটাদাগে অর্থনীতিতে তিনটি সমস্যা ছিল। সেগুলো হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট নন, বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদের হার। ডিসেম্বরে ডলারের দাম আবার কিছুটা অস্থির হয়েছে। বিনিয়োগের চিত্র আশানুরূপ নয়।
বছরজুড়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমে গেছে। ব্যবসা সম্প্রসারণও থমকে গেছে। বিদ্যমান পরিপ্রেক্ষেতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন না। বিনিয়োগের ওপর এমন নেতিবাচক প্রভাবের কারণে নতুন কর্মসংস্থান সেভাবে সৃষ্টি হয়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন স্নাতকদের অনেক কম চাকরি দিতে পেরেছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরটি বিনিয়োগ ও চাকরির জন্য ভালো ছিল না।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা বোঝার জন্য কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বোলানো যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা গত অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি কমার মানে হচ্ছে, নতুন বিনিয়োগ বা সম্প্রসারণ কমেছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতিমধ্যে ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা সব ধরনের বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়া কমেছে। গত অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
শুধু অস্থিরতার কারণে গত বছর বিনিয়োগ কমেছে, তা নয়। বছরের পর বছর বিভিন্ন সমস্যার কারণে আগে থেকেই বিনিয়োগে গতি কম। জিডিপির শতকরা হিসাবে বেসরকারি বিনিয়োগ তিন বছর ধরে কমছে। গত মাসে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। চলতি বছরও প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে ব্যবসা করায় এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতিসহ অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, উচ্চ করহারসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বছরের প্রথমার্ধে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ে। জুন শেষে শ্রমশক্তির ২৬ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন। এই সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ৪০ হাজার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুন মাসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে বিনিয়োগ শ্লথ হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বেশি কিছু প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়েছে। তাতে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১৬টি কারখানা ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায়। এতে ৩০ হাজার শ্রমিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। এ ছাড়া সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন আটটি কারখানা বন্ধ হয়েছে।
জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে আশু উদ্যোগ দরকার। সেটি হলে সময়মতো অর্থ পরিশোধ ও মুনাফা প্রত্যর্পণের নিশ্চিয়তা পাবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তখনই এফডিআইয়ের সুযোগ বাড়বে। সর্বশেষ দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধাগ্রস্ত করছে। দ্রুত নির্বাচন বিনিয়োগের বিষয়ে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করবে।