রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা, তবে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় শঙ্কা
ডলার-সংকটের এই সময়ে প্রবাসী আয় গত মাসে সাড়ে ২১ শতাংশ কমে গেছে। তবে ডলার আয়ের বড় খাত পণ্য রপ্তানি এখনো ইতিবাচক ধারায় আছে। যদিও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার বেশ কমে গেছে। এতে রপ্তানি নিয়েও নতুন করে দুশ্চিন্তা তৈরি হচ্ছে। কারণ, অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক নিম্নমুখী থাকলেও প্রবাসী ও রপ্তানি আয়—এই দুটি সূচকে এত দিন স্বস্তি ছিল।
সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসে ৪৭৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের দাম ১০৮ দশমিক ৫ টাকা ধরে)। এই রপ্তানি গত বছরের আগস্টের তুলনায় ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। যদিও গত বছরের আগস্টে ৪৬১ কোটি ডলারের রপ্তানির বিপরীতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। সেই হিসাবে গত মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩২ শতাংশীয় পয়েন্ট।
এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৯৩৭ কোটি ৫১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। যদিও অর্থবছরের প্রথম মাস শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল সোমবার পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি থাকায় চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। যদিও জুলাইয়ের তুলনায় গত মাসে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, বাইসাইকেলসহ প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি গত অর্থবছরে কমে গিয়েছিল। সেই ধারা থেকে এই খাতগুলো এখনো বের হতে পারেনি। তবে এই সময়ে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি জুতা, প্লাস্টিক পণ্য ও হস্তশিল্পের রপ্তানি বেড়েছে।
বাংলাদেশ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ডলার-সংকটে ভুগছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার। এতে ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের ওপর চাপ আরও দীর্ঘ হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, গত দেড় বছরে রিজার্ভ অর্ধেকে নেমেছে। প্রায় প্রত্যেক মাসেই রিজার্ভ কমছে। মাঝে এক মাস বেড়েছিল। এভাবে চলতে থাকলে ডিসেম্বরে রিজার্ভ ১৭-১৮ বিলিয়নে নামতে পারে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় আমরা বরাবরই প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। তবে প্রবাসী আয় প্রায়ই কমছে। অন্যদিকে পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হারও নিম্ন। এটি সত্যিই অশনিসংকেত।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মোট পণ্য রপ্তানির ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। রপ্তানি হয়েছে ৭৯৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পোশাক। এই রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাক খাতের মধ্যে ৪৫৮ কোটি ডলারের নিট পোশাক এবং ৩৪১ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ সময়ে নিট পোশাকে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। ওভেন পোশাকের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, গত জুলাইয়ে ৩৯৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তখন প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আগস্টে সেই প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশে। রপ্তানি হয়েছে ৪০৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ক্রয়াদেশের অনুসন্ধান আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে। তারপরও আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত পোশাকের রপ্তানি পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা কম। আশা করছি, জানুয়ারি থেকে রপ্তানি বাড়বে।’
চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাকের পর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ১৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি কমেছিল পৌনে ২ শতাংশ। তার মানে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এদিকে গত জুলাই–আগস্টে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এই খাতের রপ্তানি কমেছে দশমিক ৮০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১৪ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য, ১২ কোটি ৫১ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল, ৮ কোটি ডলারের জুতা, ৬ কোটি ডলারের হিমায়িত খাদ্য এবং সাড়ে ৩ কোটি ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ১০ দশমিক ৩১, হোম টেক্সটাইল ৫৩ এবং হিমায়িত খাদ্যের রপ্তানি কমেছে ২৫ শতাংশ কমেছে। আর জুতা রপ্তানি সাড়ে ৬ শতাংশ এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি সাড়ে ৫ শতাংশ বেড়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে ডলারের দাম বাজারদরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। তাতে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার সঙ্গে রপ্তানি ক্রয়াদেশ বাড়বে। অন্যদিকে হুন্ডিও কিছুটা কমবে। ডলারের দাম বাড়লে আমদানি খরচও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে কর কাঠামো সমন্বয় করলে চাপ কিছুটা কমবে।
অন্যদিকে রপ্তানি খাতে ছোটখাটো সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কারণ, আমাদের সবকিছু পোশাক খাতকেন্দ্রিক, অন্য খাত কী পেল, না পেল সেটি দেখার বিষয় না। এ ছাড়া রপ্তানি বাড়াতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে।