ঋণে ভাগ্যবদল ছোট উদ্যোক্তাদের
বিশ্ব এমএসএমই দিবস আজ। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ঋণ প্রদানে। তারপরও অর্থায়নই প্রধান সমস্যা খাতটির। এমএসএমই দিবস সামনে রেখে এই আয়োজন।
ময়মনসিংহের সিরাজুল ইসলাম তাজুল ২০০৪ সালে ঢাকায় এসে একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নেন। এরপর নিজের ও পরিবারের পুঁজিতে ২০১০ সালে ছোট আকারে গড়ে তোলেন তাজুল প্লাস্টিক টয়েজ ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০১৮ সালে তাঁকে প্রথম ঋণ দেয় বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক। এরপর ধীরে ধীরে যুক্ত হয় বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সবশেষ ডাচ্–বাংলা ব্যাংক। এখন প্রতি মাসে প্রায় ২ কোটি টাকার খেলনা বিক্রি করেন সিরাজুল ইসলাম। নিজের ভাগ্যবদলের পাশাপাশি তাঁর দুটি কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ২০০-২৫০ জনের। তাঁর মতো উদ্যোক্তাদের কারণে কমে গেছে বাচ্চাদের খেলনা আমদানিও। আগে এসব খেলনার পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর।
সিরাজুল ইসলামের মতো কয়েক লাখ উদ্যোক্তার ভাগ্যবদল হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ঋণে। এর বাইরে এ খাতের আরও অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন নিজের, পরিবারের ও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণে। ফলে দেশে এক দিকে এ খাতে যেমন বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে, অন্য দিকে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছেন অনেক উদ্যোক্তা। তবে বাংলাদেশে সিএমএসএমই খাতে যে গতি এসেছিল, করোনার কারণে সেই গতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। করোনার ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা। ফলে এ খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রবৃদ্ধিও অনেকটা কমে গেছে।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পেয়েছিলেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এখন ঋণের সুদ বেড়ে ১৪-১৫ শতাংশে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নারী উদ্যোক্তা, নতুন উদ্যোক্তা, কৃষি উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ও কম সুদে নানা তহবিলের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে অনেক উদ্যোক্তা কম সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসার সুযোগ পাচ্ছেন। তহবিলের আওতায় কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাহিদামতো পুনঃ অর্থায়ন সুবিধা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে অনেক ব্যাংক এখন এ খাতে কম সুদের ঋণের রাশ টেনে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সিএমএসএমই ঋণে গ্যারান্টি সুবিধা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাতে ব্যাংকগুলো এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে উৎসাহী হয়।
দেশের জাতীয় শিল্পনীতিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ব্যাংকঋণের ২৫ শতাংশ বিতরণ করতে হবে সিএমএসএমই খাতে। এই লক্ষ্য অর্জনে এক দশক ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে নানা ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তবে তাতে সাড়া মিলছে কম। গত বছর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৯ শতাংশ ছিল এই খাতে।
ঋণ বাড়ল কতটা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সিএমএসএমই খাতে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫২ হাজার ৮২ কোটি টাকায়। ২০২২ সালে এই খাতে ঋণ বেড়ে হয় ২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৯১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ওই সময়ে সিএমএসএমই খাতের ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। এ ঋণ পেয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ১৬টি প্রতিষ্ঠান।
বেসরকারি খাতের শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এসএমই ঋণের চাহিদা কমে গেছে। তবে অন্যদের চেয়ে এই ঋণ আদায়ের হার অনেক বেশি। উচ্চ সুদ ও বড়দের কারণে এই খাতের অনেক উদ্যোক্তা চাপে পড়েছেন। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ভর্তুকি ও করছাড়–সুবিধা দেওয়া হলে তাতে অনেকেই এসব খাতে আগ্রহী হবেন। এতে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে।
কারা বেশি ঋণ দিচ্ছে
বেসরকারি ৪৩টি ব্যাংকের মধ্যে ১৫টি ব্যাংকের সিএমএসএমই ঋণ ১৫ শতাংশের নিচে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। উত্তরা ব্যাংকের ঋণের ৫৪ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে। ব্র্যাক ব্যাংকের সিএমএসএমই ঋণ ৫০ শতাংশের ওপরে। একইভাবে এনআরবি কমার্শিয়ালের ৩৯ শতাংশ, সাউথবাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ৩৬ শতাংশ ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৩৩ শতাংশ ঋণ সিএমএসএমই খাতে। সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে সিএমএসএমই খাতে ২ লাখ ৯১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
এদিকে ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির সিএমএসএমই ঋণ ১৫ শতাংশের নিচে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সব মিলিয়ে ১২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এই খাতে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের এমডি এম জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে এই খাতের ব্যবসার গতি ধীর হয়ে এসেছিল। এখন এসব ঋণে ১০-১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আরও এক-দুই বছর এই খাত ভালো থাকলে আমাদের ঋণ আরও বাড়বে। এতে দেশে কর্মসংস্থানও হবে।’