২০২৪ সালে যেসব বড় সংস্কারের শর্ত আইএমএফের
ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ তিনটি কর্মসূচির আওতায় পালন করার জন্য বাংলাদেশকে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড় পেতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করার কথা রয়েছে আগামী জুন মাসে। এর আগে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যালোচনা করবে। তৃতীয় কিস্তির জন্য যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে করছাড় কমানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়, ভর্তুকি যৌক্তিক করার কৌশল নির্ধারণ এবং খেলাপি ঋণ কমানো।
চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের পর্যালোচনা আগামী ডিসেম্বর মাসে। তখন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তালিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা, ব্যাংক খাতের তদারকিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি সুদহারের কাঠামো ঠিক করা; রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি কমানো—এসব বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করেছে আইএমএফ। ওয়াশিংটনে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে গত মঙ্গলবার সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় কিস্তির ঋণের অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। আজ বৃহস্পতিবার এই অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে আসতে পারে।
ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ তিনটি কর্মসূচির আওতায় পালন করার জন্য বাংলাদেশকে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে। আইএমএফের ওই অর্থ পেতে ২০২৪ সালে বড় ধরনের বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, আগামী ২০২৪ সালটি হতে হবে আইএমএফের সংস্কারের শর্ত পূরণে দৃশ্যমান উদ্যোগের বছর।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বেশ কিছু বড় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এই শর্ত পূরণ করতে না পারলে পরের পর্যালোচনায় পার পাওয়া কঠিন হবে। সামনে বাংলাদেশের জন্য অনেক কাজ আছে। এত বড় সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কিছুই হবে না। তিনি মনে করেন, সংকট মোকাবিলায় সংস্কারের জন্য তড়িৎকর্মা অর্থমন্ত্রী এবং একটি দক্ষ দল লাগবে।
জুনের আগে যেসব শর্ত
আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, আগামী জুন মাসের মধ্যে রাজস্ব, আর্থিক, জ্বালানি, সামাজিক নিরাপত্তা—এই চারটি খাতেই দৃশ্যমান বড় সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব খাতে সংস্কারের অন্যতম হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং শুল্ক খাতে বছরের পর বছর যেসব কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা কমাতে হবে। ইতিমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য সামস উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এ লক্ষ্যে একটি দল কাজ করছে। আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আয়কর খাতে কত ছাড় দেওয়া হয়েছে—সম্প্রতি এনবিআর তার হিসাব করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাবে, দেশে বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার করপোরেট কর ছাড় দেওয়া হয়।
বাকি প্রায় সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয় ব্যক্তিপর্যায়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে। দুই শতাধিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৯৭টি খাতে কর ছাড় দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ, বিনিয়োগ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিল্প খাতে সহায়তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সুরক্ষা, শেয়ারবাজার চাঙা করা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহায়তা, রপ্তানি উন্নয়ন, শিক্ষা সহায়তাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এসব কর ছাড় দেয় এনবিআর।
এ ছাড়া চলতি অর্থবছর থেকেই মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায়ের যে শর্ত আছে, তাতে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা দেখাতে হবে তৃতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের আগেই। আগামী জুন মাসে চলতি অর্থবছর শেষ হবে। বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়। তবে আইএমএফ এই লক্ষ্য কমিয়ে বলেছে, ৪ লাখ কোটি টাকা আদায় করলেই হবে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) অবশ্য মাত্র ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর পেয়েছে এনবিআর।
আগামী বাজেটের আগে ভ্যাট ও কাস্টমস শাখায় একটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপন করতে হবে। তবে এনবিআর দুটি এমন ইউনিট স্থাপন করেছে। এসব ইউনিট অবশ্য এখনো পুরোদমে কাজ শুরু করেনি।
জুনের আগে সরকারের দেওয়া ভর্তুকির ক্ষেত্রে দুটি বড় শর্ত আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দর ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার একটি ‘দাম নির্ধারণ কৌশল’ তৈরির কাজ করতে হবে সরকারকে। আবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নেওয়া কর্মসূচিগুলো যৌক্তিক করার শর্ত আছে। এই শর্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্য হলো, প্রকৃত সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি যেন সুরক্ষা বাড়ানো যায়।
জুন মাসের আগে আইএমএফের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের অনুপাত কমানো; মূলধনের জোগান বাড়ানো; প্রভিশনিং রাখা—এসব শর্ত পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ১০ শতাংশের নিচে রাখার কথা বলেছে আইএমএফ। সর্বশেষ হিসাবে, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ শতাংশের মতো খেলাপি হয়ে আছে। তবে সমস্যার বিষয় হলো, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে এই হার এখনো ২৫ শতাংশ।
এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে আন্তর্জাতিক আর্থিক রিপোর্টিং মান বা আইএফআরএস অনুযায়ী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করার শর্তও আছে। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে। বিদেশি ঋণ পরিশোধসহ যাবতীয় ব্যবস্থাপনার একটি পরিকল্পনা বানানোর কথাও বলেছে আইএমএফ।
ডিসেম্বরের আগে যেসব শর্ত
জুন মাসের আগে নেওয়া ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের শর্তগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি কতটা হয়েছে—এটিও ডিসেম্বর মাসে পর্যালোচনা করে দেখা হবে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে বেশ কিছু বড় শর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন ডিসেম্বর মাসের আগে সংশোধিত দেউলিয়া আইন এবং সংশোধিত অর্থঋণ আদালতের আইন জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা আছে।
এ ছাড়া ব্যাসেল-৩-এর মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তালিকাসহ প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের সম্পদের তালিকা তৈরি করা শুরু করেছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতের তদারকি বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বাস্তবায়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে এমন শর্ত আছে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি প্রকাশ করতে হবে। নীতি সুদহার নির্ধারণের বিষয়টি একটি কাঠামোর মধ্যে আনার শর্তও দিয়েছে আইএমএফ।
আইএমএফের সর্বশেষ পরামর্শ
গত মঙ্গলবার দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের সময় বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এর মধ্যে রয়েছে স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সতর্কতার সঙ্গে মুদ্রানীতির রাশ টেনে ধরা এবং এর সহায়ক নীতি হিসেবে নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি ও মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে আরও নমনীয় হওয়া। মুদ্রার একক বিনিময় হার গ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আইএমএফ এ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আরও নমনীয় হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে। তারা মনে করে, অর্থনীতির বহিস্থ ধাক্কা মোকাবিলায় এটি জরুরি।
দেশের অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই নানাবিধ সংস্কার প্রয়োজন—উচ্চ মধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছাতে গেলে এসব জরুরি বলে মনে করে আইএমএফ। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানো, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে শ্রমশক্তিতে বাণিজ্য উদারীকরণ, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন, শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা জরুরি।
২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ। ছয় মাস পর সংস্থাটি এ বছরের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বলা হয়, ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে এ অর্থ। গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির অর্থ ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।