টিকে থাকতে শুল্ক-করে ছাড় চান ব্যবসায়ীরা

করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে আগামী বাজেটে করপোরেট কর, ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর ছাড় চান ব্যবসায়ীরা।

করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে চান ব্যবসায়ীরা। এ জন্য শুল্ক-করে নানা ধরনের ছাড় চান তাঁরা। আছে করের বোঝা কমাতে করপোরেট কর কমানোর দাবি। আবার ভ্যাটেও ছাড় চান। দেশের ব্যবসায়ীদের মূল দাবি এখন ব্যবসা-সহায়ক একটি করব্যবস্থা।

বাংলাদেশের করপোরেট কর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। আগাম ভ্যাটের নামে টাকা কেটে রাখায় উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানে নগদ টাকায় টান পড়ে। বিক্রিবাট্টার এই মন্দায় পণ্যের প্রচার-প্রসারেও ইচ্ছেমতো খরচ করা যাচ্ছে না। ভ্যাট না দিলে জরিমানার ঝুঁকি তো আছে। করোনার সময় এমনিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ধুঁকছে। এমন অবস্থায় লোকসান হলেও ন্যূনতম কর দিতে হবে। আগামী বাজেট থেকে এসব বিষয়ে শুল্ক-করে ছাড়ের প্রত্যাশা করেন দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা নমনীয়। আসছে করপোরেট কর কমানোর ঘোষণা। আগাম ভ্যাট কমানোর পাশাপাশি ভ্যাটেও নানামুখী ছাড় থাকতে পারে। কর অবকাশ সুবিধার আওতায় আসতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নতুন নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ। কর অবকাশের তালিকায় যুক্ত হতে পারে কৃষি, ফল ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত শিল্প, ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদি। তবে কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ সীমিত করা হতে পারে।

করোনার প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে শুল্ক-করে ছাড় দিতে হবে। আবার ভোক্তা খরচে উদ্বুদ্ধ করতে সাধারণ করদাতাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে।
আবুল কাশেম খান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক

আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ২৯ হাজার কোটি টাকা বেশি।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাশেম খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে শুল্ক-করে ছাড় দিতে হবে। আবার ভোক্তা খরচে উদ্বুদ্ধ করতে সাধারণ করদাতাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য এখন পুনরুদ্ধার হচ্ছে। যদি বিভিন্ন পর্যায়ে অগ্রিম কর ও আগাম ভ্যাট কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়বে। তারা সংকটে পড়বে না। হাতে টাকা থাকলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সমস্যা হবে না। আবার করপোরেট কর কমিয়ে দিলে মুনাফাও বাড়বে, যা পুনরায় বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে।

বাংলাদেশের করপোরেট করহার পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। এমনকি ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এ দেশগুলোর তুলনায়ও বেশি। ভারতে করপোরেট করহার ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানকেই ৩০ শতাংশের বেশি কর দিতে হয়।

করপোরেট কর বেশি

দীর্ঘদিন ধরেই করপোরেট করহার কমানোর দাবি করে আসছেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করপোরেট করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহার ২৫ শতাংশ। বর্তমানে মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং সিগারেট ও তামাকজাতীয় পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের করহার ৪৫ শতাংশ; শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক সাড়ে ৩৭ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন ব্যাংককে ৪০ শতাংশ কর দিতে হয়। সাধারণত শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারকেই করপোরেট কর হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র এক হাজারের মতো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রায় ৩৫ হাজার প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন হারে কর দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের করপোরেট করহার পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। এমনকি ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এ দেশগুলোর তুলনায়ও বেশি। ভারতে করপোরেট করহার ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানকেই ৩০ শতাংশের বেশি কর দিতে হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানে ব্যাংকের করহার ৩৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ব্যাংকের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। অন্য কোম্পানির করহার ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া ছোট কোম্পানিকে ২২ শতাংশ কর দিতে হয়। ভিয়েতনামের করহার গড়ে ২০ শতাংশ।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়—এই দুই শ্রেণিতে আড়াই শতাংশ করে করপোরেট কর কমতে পারে। ব্যাংক, মোবাইল কোম্পানি, সিগারেট কোম্পানিসহ অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীদের অন্যতম একটি বড় দাবি হলো লাভ-লোকসান নির্বিশেষে টার্নওভারের ভিত্তিতে ন্যূনতম কর প্রত্যাহার করা। এখন একটি প্রতিষ্ঠানের বছরে তিন কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেই লেনদেনের ওপর দশমিক ৫ শতাংশ কর দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই করহার সিগারেট কোম্পানি ও মোবাইল ফোন অপারেটরদের জন্য যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ। এ ধরনের করারোপের ফলে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোই বেশি বিপাকে পড়ে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এই বিষয়ে আগামী বাজেটে কোনো সুখবর না-ও পেতে পারেন ব্যবসায়ীরা।

করোনা শুরু হওয়ার সব ব্যবসায়ীর বেচাবিক্রি ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু পণ্যের প্রচারে পর্যাপ্ত খরচ করতে পারছেন না। কারণ, প্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রচার-প্রসারে মোট লেনদেনের দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করলে কর দিতে হয় না। এটি বাড়ানোর দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের যুক্তি, পণ্য বিক্রির জন্য প্রচারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করতে হয়। পণ্য বিক্রি হলে এমনিতেই আয় বাড়বে, করের পরিমাণও বাড়বে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রচার-প্রসারে খরচ মোট লেনদেনের ১ শতাংশ পর্যন্ত করমুক্ত করা হতে পারে।

কালোটাকার ঢালাও সুযোগ বন্ধ হতে পারে

চলতি অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট-জমি কেনার পাশাপাশি ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ করা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। এমনকি নগদ টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১০ হাজারের বেশি এই সুযোগ নিয়েছেন, এর মধ্যে সিংহভাগই নগদ টাকা সাদা করেছেন। প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে।

এভাবে ঢালাও সুযোগের ফলে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। একজন সৎ করদাতা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে কর দেবেন। আর অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে ফেলবেন কালোটাকার মালিকেরা। ব্যবসায়ীরা প্রাক্-বাজেট আলোচনায় ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিপক্ষে মত দেন। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ঢালাওভাবে এই সুযোগ বন্ধ হতে পারে।

কম ভ্যাটে স্বস্তি চান ব্যবসায়ীরা

এই করোনাকালে সবার কমবেশি ব্যবসা-বাণিজ্য কমেছে। তাই তাঁরা ভ্যাটেও ছাড় চান। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, আমদানি পর্যায়ে ৪ শতাংশ আগাম কর বা আগাম ভ্যাট দিতে হয়। এই ভ্যাটের টাকা ফেরত পেতে ব্যবসায়ীদের কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু কাঁচামাল, মধ্যবর্তী ও প্রস্তুত পণ্য আমদানিকারকেরা পণ্য হাতে পাওয়ার আগেই ভ্যাটের টাকা কেটে রাখা হয়। ফলে তাঁদের বিপুল পরিমাণ টাকা এনবিআরের হাতে আটকে থাকে। করোনার বিপদে বহু প্রতিষ্ঠান পরিচালনা খরচের জন্য টাকার সংকটে ভুগছে। তাই আগাম ভ্যাট প্রত্যাহার চান ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে শুধু উৎপাদন খাতের আমদানিতে আগাম ভ্যাট ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হতে পারে।

করোনার সময়ে লকডাউন বা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপের অনেক ব্যবসায়ী রিটার্ন জমা দিতে পারেননি। অনেকের আয় কমে যাওয়ায় রিটার্ন দেননি। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এমন দুর্যোগের সময়ে ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দিতে জরিমানার পরিমাণ কমানো হচ্ছে। রিটার্ন দিতে না পারলে আরোপিত ভ্যাটের ওপর ২ শতাংশ সুদ আরোপের পরিবর্তে ১ শতাংশ সুদ আরোপ হতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়লে আরোপিত ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা করার বিধান আছে। এটি কমিয়ে ভ্যাটের সমপরিমাণ করা হতে পারে।

তবে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হলে ভ্যাট দিতে হবে না। ব্যবসায়ী মহল থেকে এই সীমা এক কোটি টাকায় উন্নীত করার দাবি জানানো হলেও এনবিআরের তাতে মত নেই। এমনকি টার্নওভার করের সীমা তিন কোটি টাকাও বাড়ানো হচ্ছে না।

করমুক্ত আয়সীমায় ছাড় নেই

গত বছর ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। করোনার সময়ে বহু করদাতার আয় কমে গেছে। চাকরি গেছে অনেকের, ব্যবসায় লোকসান গুনছেন বহু ব্যবসায়ী। ভারতে একজন করদাতার বার্ষিক আয় আড়াই লাখ রুপি পেরোলেই কর দিতে হয়। তবে আড়াই থেকে পাঁচ লাখ রুপি পর্যন্ত আয়ের ওপর মাত্র ৫ শতাংশ কর দিতে হয়। বাংলাদেশের করদাতারা করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ হলেও কমহারে অর্থাৎ মাত্র ৫ শতাংশ কর দিতে হয় পরের এক লাখ টাকার ওপর। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় স্বল্প আয়ের করদাতারা বেশি করছাড় পান।

অন্যদিকে পাকিস্তানে একজন চাকরিজীবী করদাতার ৬ লাখ রুপি পর্যন্ত কোনো কর নেই। আর বেতনভুক্ত নন এমন করদাতাদের ক্ষেত্রে চার লাখ রুপি পর্যন্ত কর নেই।
ভারত ও পাকিস্তানের করদাতাদের ন্যূনতম কর বলতে কিছু নেই। অথচ বাংলাদেশের করদাতাদের ন্যূনতম ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর পক্ষে নয় এনবিআর। বর্তমানে ৬২ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে বছরে মাত্র ২৫ লাখ রিটার্ন দেন।