জিডিপির হিসাবে তিন খাত নিয়ে প্রশ্ন

বিদায়ী ২০২০–২১ অর্থবছরে জিডিপির হিসাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব নেই।

করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য কখনো কমে যায়, কখনো স্থবির হয়। করোনার কারণে এক বছর ধরে পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ছোট শিল্পকারখানা বড় ধরনের বিপাকে পড়লেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য–উপাত্ত বা পরিসংখ্যান বলছে, এসব খাত চাঙা ছিল। এসব খাতে আগের চেয়ে মূল্য সংযোজন বেড়েছে। এ কারণে বিবিএসের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সম্প্রতি বিবিএস ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করেছে। তাতে সাময়িক হিসাবে ২০২০–২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং চূড়ান্ত হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ১৭টি খাতে মূল্য সংযোজন কত হলো, এর ওপর ভিত্তি করে জিডিপি গণনা করা হয়। সাময়িক হিসাব সাধারণত অর্থবছরের প্রথম ৮-৯ মাসের প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুরো অর্থবছরের হিসাব করা হয়।

এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ কয়েকটি খাতের প্রকৃত চিত্র আসেনি।

পরিবহন খাত এত চাঙা!

গত দুই অর্থবছরে পরিবহন খাতের মূল্য সংযোজন বেড়েছে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে পরের দুই মাসের বেশি সময় ধরে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। কিন্তু বিবিএস বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে। ওই অর্থবছরে পরিবহন খাত থেকে অর্থনীতিতে ২ লাখ ৪১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা যুক্ত হয়েছে।

পরের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বছরজুড়েই গণপরিবহন চলাচলে নানা ধরনের বিধিনিষেধ ছিল। গত এপ্রিলের পর কয়েক দফায় গণপরিবহন সাময়িকভাবে বন্ধও রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিবিএসের সাময়িক হিসাব বলছে, দেশের বাস-ট্রাক, লঞ্চ, রেল, বিমানসহ পরিবহন খাতটি অর্থনীতিতে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বা ১০ শতাংশের বেশি মূল্য সংযোজন বা সেবা দিয়েছে। পরিবহন খাতে গত এপ্রিলের পরের প্রভাব আমলে নেওয়া হয়নি।

২০২০-২১ অর্থবছরজুড়েই অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলেছে। কিন্তু বিবিএসের হিসাব বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে বাস, ট্রাক, ট্রেন—এসবের মূল্য সংযোজন আগের বছরের চেয়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। নৌযান চলাচলে বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। করোনা শুরু হওয়ার পর বিমান চলাচল আর স্বাভাবিক হয়নি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি চলেনি। অথচ বিবিএস বলেছে, বিমান চলাচলে আগেরবারের চেয়ে ৬৬ কোটি টাকা বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে করোনার বছরে পরিবহন খাতে আগেরবারের চেয়ে ৬৫৩ কোটি টাকা বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে।

হোটেল-রেস্তোরাঁর অবদান বেড়েছে ৩৬৪৯ কোটি

করোনার সময়ে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের এপ্রিল-মে মাস হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। ওই অর্থবছরে জিডিপিতে হোটেল রেস্তোরাঁর অবদান ছিল ২৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ২ হাজার কোটি টাকা বেশি।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী সমিতির প্রধান উপদেষ্টা খন্দকার রুহুল আমিন প্রথম আলোকে জানান, গত এক বছর রেস্তোরাঁয় ব্যবসায় রীতিমতো ধস নেমেছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেক বেচাকেনাও হয়নি। সবাই টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

ছোট শিল্প নাকি ভালো ছিল

করোনার সময়ে সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিলেন ছোট শিল্পের উদ্যোক্তারা। বিবিএসের হিসাব কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থনীতিতে ছোট শিল্পের অবদান বেড়েছে যথাক্রমে ৯ হাজার কোটি ও ৬ হাজার কোটি টাকা (চলতি মূল্যে)।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিবিএসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা আগের বছরের চেয়ে ভালো ছিল। আমরা ৮-৯ মাসের তথ্যের ভিত্তিতে বার্ষিক হিসাবটি করেছি। গতবার প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ভিত্তিও কমেছে, তাই এবার একটু বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে। তবে এপ্রিল মাসের পরের প্রকৃত হিসাব পেলে এসব খাতের অবদান কমতে পারে।