প্রকল্পের ‘চুরি’ ধরতে আসছে ড্রোন
চলতি মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র দেখতে যান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কর্মকর্তারা। যাওয়ার সময় তাঁরা নিয়ে গেছেন ড্রোন। এগুলো উড়িয়ে তাঁরা প্রকল্পের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি বানানো হয়েছে। আইএমইডির কর্মকর্তাদের পক্ষে এই চিমনির ওপরে উঠে কাজ ঠিকমতো হয়েছে কি না, তা দেখা সম্ভব নয়। সে জন্য তাঁরা প্রকল্প এলাকায় ড্রোন ওড়ান। চিমনির মুখে ড্রোন স্থির করে যাবতীয় নির্মাণকাজ দেখেন। এ ছাড়া চিমনির চারপাশ ঘুরে ঘুরে ড্রোনটি ছবিও তোলে।
ঠিকাদারের কথা শুনে আইএমইডির কর্মকর্তারা থেমে না গিয়ে একটি ড্রোন ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ড্রোনটি দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা গেল, বাঁধ আর নির্মাণই করা হয়নি।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামাল রাখা হবে তিনটি শেডে। এর মধ্যে দুটি শেডের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। অন্যটি এখন নির্মাণাধীন আছে। আকাশে ড্রোন উড়িয়ে কাঁচামাল রাখার তিনটি শেডের নির্মাণকাজের অগ্রগতিও দেখেন আইএমইডির কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী প্রকল্প এলাকায় কতটুকু জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তার প্রকল্প দলিলের হিসাবের সঙ্গে মিল আছে কি না, সেটিও ড্রোন দিয়ে মাপজোখ করা হয়। এভাবে ড্রোনের সাহায্যে পুরো মাতারবাড়ী প্রকল্প পর্যবেক্ষণ করা হয়।
কয়েক মাস আগে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলায় নদীভাঙন রোধে বাঁধ দেওয়ার আরেকটি প্রকল্পে যান আইএমইডির কর্মকর্তারা। সেখানে বাঁধের ওপর রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। ১৩ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে চার কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান ঠিকাদার। তিনি আইএমইডির কর্মকর্তাদের বলেন, সামনে কাদাপানি আছে, গাড়িতে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না।
ঠিকাদারের কথা শুনে আইএমইডির কর্মকর্তারা থেমে না গিয়ে একটি ড্রোন ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ড্রোনটি দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা গেল, বাঁধ আর নির্মাণই করা হয়নি। অর্থাৎ চার কিলোমিটার নয়, মাত্র দেড় কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়েছে। ড্রোনে প্রকল্পের কাজ নিয়ে ঠিকাদারের ‘মিথ্যা কথা’ ও ‘চুরি’ ধরা পড়লেও তিনি অবশ্য বলেন, আশপাশের বাসিন্দারা মাটি উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি আইএমইডি কর্মকর্তারা। তাঁরা প্রকল্প পরিচালককে ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেন।
প্রকল্প পরিদর্শন নিয়ে আইএমইডির কার্যক্রম সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তারা ঠিকমতো প্রকল্প পরিদর্শন ও মূল্যায়ন করে না। প্রযুক্তি নিজে প্রকল্প পরিদর্শন করে দেবে না। প্রযুক্তি পরিচালনা করবেন কর্মকর্তারা। ড্রোন ব্যবহার করে চাপ ও প্রভাবমুক্ত থেকে তাঁরা প্রকল্প পরিদর্শন ও মূল্যায়নের কাজ কতটা করতে পারবেন, তা এখন দেখার বিষয়।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম)
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাস্তা নির্মাণে ‘মিথ্যা কথা’ ও ‘চুরি’ ধরার পরে আইএমইডির কর্মকর্তারা প্রকল্পের কাজ নজরদারিতে নিয়মিত ড্রোন ব্যবহারে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তাঁরা বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শনে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রোন ব্যবহার করছেন। এ জন্য ইতিমধ্যে তিনটি ড্রোন কেনা হয়েছে। এখন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ পর্ব চলছে।
প্রকল্প পরিদর্শনে প্রযুক্তির ব্যবহারকে স্বাগত জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প পরিদর্শন নিয়ে আইএমইডির কার্যক্রম সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তারা ঠিকমতো প্রকল্প পরিদর্শন ও মূল্যায়ন করে না। প্রযুক্তি নিজে প্রকল্প পরিদর্শন করে দেবে না। প্রযুক্তি পরিচালনা করবেন কর্মকর্তারা। ড্রোন ব্যবহার করে চাপ ও প্রভাবমুক্ত থেকে তাঁরা প্রকল্প পরিদর্শন ও মূল্যায়নের কাজ কতটা করতে পারবেন, তা এখন দেখার বিষয়।
অনুমতির জন্য অপেক্ষা
২০২২ সালের মে মাসে ডিজেআই ব্র্যান্ডের ফ্যান্টম ও মেভিক মডেলের তিনটি ড্রোন কেনে আইএমইডি। প্রতিটির দাম পড়ে প্রায় তিন লাখ টাকা। এ ব্যাপারে গত সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ। এখন পর্যন্ত দফায় দফায় ২৫-২৬ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
জানা গেছে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আশপাশে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ওই এলাকার আশপাশে পুরোনো বিমানবন্দর, জাতীয় সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনসহ বেশ কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। তাই পূর্বাচল কিংবা মুন্সিগঞ্জ গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
দামি ড্রোন ওড়াতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনসহ (বিটিআরসি) সরকারের কয়েকটি দপ্তরের অনুমতি লাগে। আইএমইডির পক্ষ থেকে এসব দপ্তরের অনুমতি নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। ড্রোনের ওজন পাঁচ কেজির বেশি হলে সে ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয়। ভবিষ্যতে উচ্চ প্রযুক্তির এমন ড্রোনই ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে আইএমইডি।
আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, লেইডার প্রযুক্তির ড্রোন কিনবে তারা। কারণ, এই প্রযুক্তির ড্রোন দিয়ে আকাশ থেকে পানির নিচের গভীরতাও মাপা যায়। এই ড্রোন নদী খনন প্রকল্প পরিদর্শনের সময় ব্যবহার করা যাবে। কারণ, ঠিকাদারেরা নদীর তলদেশ যতটা গভীর করে খনন করার কথা, তা করেন না বলে অভিযোগ আছে। আবার পানির নিচে গিয়ে গভীরতাও মাপা যায় না। তাই লেইডার প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করবে আইএমইডি। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার জমি অধিগ্রহণ ঠিকমতো হয়েছে কি না, সেটি দেখার জন্য জিও ম্যাপিং প্রযুক্তির ড্রোন কেনার পরিকল্পনা আছে আইএমইডির।