আলোচিত সেই রুশ জাহাজ ‘উরসা মেজর’ ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছে

২০২৩ সালের ১১ এপ্রিলে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার কার্গো জাহাজ উরসা মেজর তুরস্কের বসফরাস চ্যানেল অতিক্রম করছে।ছবি: রয়টার্স

উরসা মেজর নামের রাশিয়ার একটি কার্গো জাহাজ ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, জাহাজটির ইঞ্জিনরুমে এক বিস্ফোরণের পর আগের রাতে এটি ডুবে যায়। কিছু নাবিককে উদ্ধার করা গেলেও দুজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলেও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

রয়টার্স জানায়, ২০০৯ সালে নির্মিত জাহাজটি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্মাণ বিভাগের কোম্পানি অবরোনলজিস্টিকা নিয়ন্ত্রণ করত। কোম্পানিটি এর আগে জানিয়েছিল যে জাহাজটি রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর ভ্লাদিভোস্টকে যাচ্ছিল এবং এটি দুটি বিশাল আকারের পোর্ট ক্রেন বহন করছিল।

আরও পড়ুন

দুই বছর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উরসা মেজর নামের একটি জাহাজ বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে এসেছিল। উরসা মেজরের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় সম্ভাব্য ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ তখন জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। যদিও জাহাজটিকে বন্দরে পণ্য খালাসের অনুমতি দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল রাশিয়া।

রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্রাইসিস সেন্টারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাহাজে ১৬ জন নাবিকের মধ্যে ১৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং তাঁদের স্পেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তবে ইঞ্জিনরুমে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে ওই বিবৃতিতে কিছু বলা হয়নি।

আরও পড়ুন

স্পেনে রাশিয়ার দূতাবাসের উদ্ধৃতি দিয়ে আরআইও বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, যে পরিস্থিতিতে জাহাজটি ডুবে গেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং দূতাবাস স্পেনের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।

অবরোনলজিস্টিকা এবং এসকে–ইয়ুগ জাহাজডুবি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এলএসইজি) জানিয়েছে, এসকে–ইয়ুগ জাহাজটির সরাসরি মালিক ও অপারেটর। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে দুটি প্রতিষ্ঠানকেই নিষিদ্ধ করে। উরসা মেজরের ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ছিল।

যেভাবে ডুবল

এলএসইজির তথ্য বলছে, উরসা মেজর নামের জাহাজটি আগে স্পার্টা থ্রি নামে পরিচিত ছিল। এটির আরও কয়েকটি নাম ছিল। ২০ ডিসেম্বর অবরোনলজিস্টিকা এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, জাহাজটি দুটি বিশেষ পোর্ট ক্রেন নিয়ে ভ্লাদিভোস্টকে যাচ্ছিল। ক্রেন দুটি ভ্লাদিভোস্টক বন্দরে বসানোর কথা। এ ছাড়া জাহাজটি নতুন আইসব্রেকারের জন্য সরঞ্জাম বহন করছিল।

এলএসইজির জাহাজ চলাচলসংক্রান্ত তথ্যানুসারে, উরসা মেজর ১১ ডিসেম্বর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর ছেড়ে যায়। গত সোমবার গ্রিনিচ মান সময় ২২০৪ ঘণ্টায় এটি আলজেরিয়া ও স্পেনের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে সর্বশেষবার্তা পাঠিয়েছিল। ওই জায়গায়ই জাহাজটি ডুবে যায়।

সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ছাড়ার সময় জাহাজটি জানিয়েছিল যে এটি পরবর্তী গন্তব্য ভ্লাদিভোস্টক বন্দরে থামবে। সিরিয়ার বন্দর তারতুসে এটি আগে গেলেও এবার সেখানে যাওয়ার কথা ছিল না।

ইউক্রেনের এইচইউআর সেনা গোয়েন্দা সার্ভিস রাশিয়ার জাহাজ চলাচল পর্যবেক্ষেণ করে। সেটি সোমবার তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে জানিয়েছিল যে স্পার্টা নামের অন্য একটি রুশ জাহাজ পর্তুগালের কাছে সাময়িকভাবে যান্ত্রিক সমস্যায় পড়েছে। পরে এটি আপডেট দিয়ে জানায় যে স্পার্টার নাবিকেরা জাহাজটির সমস্যার সমাধান করেছেন এবং এটি সিরিয়ায় যাচ্ছে।

উরসা মেজর নিয়ে বাংলাদেশে সমস্যা

২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাহাজটি যখন বাংলাদেশে আসে, তখন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছিল, রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে জানায় যে ওই জাহাজ আসলে ‘উরসা মেজর’ নয়, সেটা মূলত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা ৩ এ’ জাহাজ। রং ও নাম বদল করে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজে করে পণ্য আসছে—এটি নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সেটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে দেয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা জাহাজে করে রাশিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য পাঠাচ্ছিল, এমন তথ্য জানার পর বাংলাদেশ ওই জাহাজ বন্দরে ভিড়তে দেবে না বলে জানিয়ে দেয়। এরপর রাশিয়া কূটনৈতিক চিঠির মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজের পণ্য ওঠানো–নামানো, জ্বালানি সরবরাহ, নাবিকদের সেবা দেওয়া হলে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া বা বড় আর্থিক দণ্ডের মুখে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

বাংলাদেশে পণ্য খালাস করতে না পেরে উরসা মেজর পরে ভারতে চলে যায়। প্রায় দুই সপ্তাহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পণ্য খালাসের জন্য অপেক্ষা করে জাহাজটি। কিন্তু পণ্য খালাসের জন্য এটি নয়াদিল্লির অনুমতি পেতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ভারতের জলসীমা ছেড়ে যায় জাহাজটি।

প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ভারত ছেড়ে রুশ জাহাজটি চীনের পথে চলে যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, রূপপুরের সরঞ্জামবাহী জাহাজ উরসা মেজর বঙ্গোপসাগর ছেড়ে গেছে বলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। সেটি রাশিয়ার বন্ধুপ্রতিম তৃতীয় কোনো দেশের বন্দরে ভিড়বে এবং সেখানে পণ্য খালাস করা হবে।