২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গতি পাচ্ছে বে টার্মিনাল প্রকল্প

চট্টগ্রাম বন্দরফাইল ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে এক দশক আগে নেওয়া নতুন ‘বে টার্মিনাল’ প্রকল্প অবশেষে গতি পাচ্ছে। এই প্রকল্পের জন্য প্রতীকী মূল্যে ৫০১ একর জমি দেওয়ার প্রক্রিয়া গত মে মাসে চূড়ান্ত হয়েছে। গত শুক্রবার প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার বা স্রোত প্রতিরোধক তৈরি এবং জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি তথা খননকাজের জন্য ৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পর্ষদ।

বিশ্বব্যাংকের নতুন এই ঋণ অনুমোদনের সুবাদে বে টার্মিনাল প্রকল্পের উন্নয়নকাজে গতি পাওয়ার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। এই প্রকল্প এলাকা চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনাল এলাকার চেয়ে বড়। বন্দর জলসীমার শেষ প্রান্তে চট্টগ্রাম ইপিজেডের পেছনের সাগরপার থেকে শুরু হবে বে টার্মিনাল প্রকল্পের সীমানা, যা গিয়ে শেষ হবে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের অদূরে রাসমণিঘাটে।বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা প্রকল্প এলাকাটি প্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার লম্বা।

বে টার্মিনাল যে গতি পাচ্ছে, তা ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই ইতিবাচক। আমরা বহু আগেই এই টার্মিনাল নির্মাণের দাবি জানিয়েছিলাম। কারণ, এটি চালু হলে কনটেইনার পরিবহন তথা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবসার খরচ কমবে। জটের মুখে পড়তে হবে না।
মাহবুবুল আলম, সভাপতি, এফবিসিসিআই

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বে টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ অনেক আগেই গতি পেয়েছে। এখন বিশ্বব্যাংকের ঋণ অনুমোদন গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে এসেছে। টার্মিনাল নির্মাণের আগে প্রথম কাজ হচ্ছে, ব্রেক ওয়াটার বা স্রোত প্রতিরোধক ও খননকাজ করে জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি করা। বিশ্বব্যাংকের ঋণে এই কাজ হবে সবার আগে। সে জন্য ব্রেক ওয়াটার ও খননবিষয়ক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। অনুমোদনের পর এই কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে।

বে টার্মিনালে মূলত জাহাজ থেকে কনটেইনার ও পণ্য ওঠানো-নামানো হবে। খোলা পণ্য সাগরে ওঠানো-নামানো গেলেও টার্মিনাল ছাড়া কনটেইনার ওঠানো-নামানো যায় না। রপ্তানি পণ্যের সিংহভাগ কনটেইনারে ভরে বিদেশে পাঠানো হয়। আবার শিল্পের কাঁচামালসহ মূল্যবান পণ্য কনটেইনারে করে আমদানি হয়। বর্তমানে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ৯৮ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি টার্মিনালে হয়। নতুন করে পতেঙ্গা টার্মিনালেও কনটেইনার ওঠানো-নামানো শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন বছরে তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ একক কনটেইনার পরিবহন হয়। বে টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে এটি বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালের চেয়ে বেশি কনটেইনার পরিবহন করা যাবে বলে বন্দরের কর্মকর্তারা জানান।

যেভাবে এল বে টার্মিনাল প্রকল্প

এক যুগ আগে বছরের বেশির ভাগ সময় জাহাজজটের মুখে পড়ত চট্টগ্রাম বন্দর। সে জন্য তখন বন্দর সম্প্রসারণে নতুন প্রকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘চট্টগ্রাম বন্দরে সুবিধাদি সম্প্রসারণ (বে টার্মিনাল)’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়ে জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয় তারা। পতেঙ্গার সাগরপারে প্রথমে ৮৭০ একর জমিতে বে টার্মিনালে গড়ে তোলার কথা ছিল।
এরপরই প্রকল্পটি নিয়ে সমীক্ষা চালানোর বিষয়ে প্রথম এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। ওই বছরই বিশ্বব্যাংকের তিনজন প্রতিনিধি প্রকল্প এলাকা ঘুরে ৪৬ পৃষ্ঠার প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা তৈরি করেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিবেদনটি বন্দরের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

বিশ্বব্যাংকের ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রথম বলা হয়েছিল, প্রকল্প এলাকাটি কনটেইনার টার্মিনালের জন্য আকর্ষণীয়। ঢাকা থেকে আসা–যাওয়ার জন্য প্রকল্প এলাকার কাছে রেল ও সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। বে টার্মিনাল হবে টেকসই বিকল্প।

বিশ্বব্যাংক প্রকল্প এলাকাকে আকর্ষণীয় বললেও শুরুতে কিন্তু কাজে অগ্রগতি ছিল না। নানা ছাড়পত্র ও জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। জমি বুঝে পাওয়া নিয়ে যে জট ছিল, সেটি এ বছরে এসে খুলে যায়। গত মে মাসে প্রায় ৫০১ একর জমি বুঝে নেওয়ার জন্য চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন। এখন পর্যন্ত ৫৬৭ একর জমি হাতে পাচ্ছে বন্দর।

বে টার্মিনালে কী থাকছে

২০১৭ সালে বে টার্মিনাল নির্মাণের কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সম্ভাব্যতা নিয়ে সমীক্ষা করে জার্মানির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেল হর্ন। তাতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে ৩০০ মিটার লম্বা এবং ১২ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য) জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব এই টার্মিনালে।

চলতি বছরে নতুন করে এই প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা ও নকশা চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী, এই প্রকল্পে মোট চারটি টার্মিনাল গড়ে তোলা হবে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ড। দুই প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। তাদের বিনিয়োগের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।

বাকি দুটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়াও এখন চলছে। আবুধাবি পোর্টস মাল্টিপারপাস নামে একটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হতে পারে। এ ছাড়া গ্যাস ও তেল খালাসের টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইস্ট কোস্ট গ্রুপ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। তারা ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।

বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল প্রথম আলোকে জানান, পিপিপির আওতায় পিএসএ এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার প্রক্রিয়া এগিয়েছে। ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজারও নিয়োগ হয়েছে। বাকি দুটি প্রস্তাবও এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে কী সুবিধা হবে

চট্টগ্রাম বন্দরের সীমাবদ্ধতা থাকায় বড় আকারের জাহাজ জেটিতে ভেড়ানো যায় না। অবশ্য দিনের বেলায় জোয়ারের সময় জাহাজ ভেড়ানো যায়। বন্দরে এখন যেসব জাহাজ চলে, সেগুলো গড়ে দেড় হাজার একক কনটেইনার আনা-নেওয়া করে। প্রস্তাবিত বে টার্মিনালে চার হাজার একক কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে। জাহাজও ভেড়ানো যাবে দিনরাত যেকোনো সময়।

বে টার্মিনাল প্রকল্প এলাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত আউটার রিং রোডের পাশে। কাছাকাছি রয়েছে রেললাইন। আবার অভ্যন্তরীণ নদীপথেও বে টার্মিনাল থেকে সরাসরি যাওয়া যাবে সারা দেশে।

জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বে টার্মিনাল যে গতি পাচ্ছে, তা ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই ইতিবাচক। আমরা বহু আগেই এই টার্মিনাল নির্মাণের দাবি জানিয়েছিলাম। কারণ, এটি চালু হলে কনটেইনার পরিবহন তথা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবসার খরচ কমবে। জটের মুখে পড়তে হবে না।’