ব্যাংকমালিক হওয়ার সহজ পদ্ধতি
নব্বইয়ের দশকে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন একদিন সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান প্রশ্ন করেছিলেন, কেন সবাই ব্যাংকের মালিক হতে চান? উত্তরটি পরে তিনিই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁরা ব্যাংকের পরিচালক হন অল্প অর্থ দিয়ে, কিন্তু তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
কথাটা মনে পড়ল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিটিজেন ব্যাংক নামে নতুন একটি ব্যাংকের চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পরে। সিটিজেন ব্যাংক দেশের ৬১তম তফসিলি ব্যাংক। লাইনে দাঁড়িয়ে আছে পিপলস ব্যাংক নামের আরেকটি ব্যাংক। এটি চূড়ান্ত লাইসেন্স পেলে হবে দেশের ৬২তম ব্যাংক। আপনি কি দেশের ৬৩তম ব্যাংকটির মালিক হতে চান? তাহলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন। আপনার জন্যই ব্যাংকমালিক হওয়ার এই সহজ পদ্ধতি।
সহজে ব্যাংকমালিক হওয়ার পদ্ধতিটি এ রকম—
১. প্রথমেই একটি নাম ঠিক করুন। নাম আসলে দুটো ঠিক করা উচিত। কোনো কারণে ব্যাংক না চললে, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জনগণ থেকে নেওয়া আমানত ফেরত দিতে না পারলে নাম বদলে দেওয়ার জন্য। এই যেমন ধরেন ছিল ফারমার্স ব্যাংক, হয়ে গেছে পদ্মা ব্যাংক। আর যদি ব্যবসা বাড়াতে এখনকার প্রবণতার সঙ্গে থাকতে চান, তাহলে একটা ইসলামি নামও ঠিক করতে পারেন। হঠাৎ একদিন ঘোষণা দিয়ে দেবেন যে আপনার ব্যাংকটি এখন থেকে ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী চলবে। আপনার জীবনযাপন যেমনই হোক না কেন, আপনি যেভাবেই প্রতিষ্ঠান দখল করেন না কেন। এরপর নামটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়পত্র দিলে তবেই নামটি আপনার হবে।
১৯৯৭ সালে ইউসিবিএল ব্যাংকের ঘটনা ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো। আবার ধরেন ন্যাশনাল ব্যাংক। এক পক্ষকে তো বাধ্য হয়ে সরে যেতেই হয়েছে। পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা এখনো কান পাতলে এখনো শোনা যায়। উদাহরণও আছে অসংখ্য।
২. এবার ঠিক করুন ব্যাংকের অংশীদার কে কে হবেন, তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। তাঁদের মধ্য থেকে ১৩ জন পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হবেন। তাঁদের সবার তথ্য বিস্তারিত দিতে হবে। অংশীদার বা পরিচালক বাছাইয়ে সতর্ক থাকুন। পর্ষদে পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন কিছু না। এমনকি পর্ষদ সভায় দুই পক্ষের মধ্যে গুলি ও লাঞ্ছিত হওয়ার ইতিহাসও আছে। ১৯৯৭ সালে ইউসিবিএল ব্যাংকের ঘটনা ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো। আবার ধরেন ন্যাশনাল ব্যাংক। এক পক্ষকে তো বাধ্য হয়ে সরে যেতেই হয়েছে। পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা এখনো কান পাতলে এখনো শোনা যায়। উদাহরণও আছে অসংখ্য।
৩. এবার সংঘ স্মারক তৈরি করুন এবং তা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দিন। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায়—এ রকম আগ্রহীর সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাও আছে অসংখ্য। গুগলে খোঁজ করলেও হয়তো দু–একটা পেয়ে যেতে পারেন।
৪. এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বৈঠক করে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তবে তালিকা কিন্তু আগেই চূড়ান্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক যা করে, তা হচ্ছে স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। সুতরাং তদবিরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে শ্রম, সময় বা অন্য কিছু ব্যয় না করাই ভালো।
৫. জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে টিআইএন সার্টিফিকেট নিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিতে হবে ট্রেড লাইসেন্স। পুরো প্রক্রিয়ায় এটাই সবচেয়ে সহজ কাজ।
৬. বাংলাদেশ ব্যাংকে ওয়েবসাইটে নতুন ব্যাংক স্থাপনের গাইডলাইন আছে। সেটাও পড়ে নিতে হবে। তবে ছোট্ট একটা সংশোধন আছে। সেখানে লেখা আছে যে ব্যাংক খুলতে ৪০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন লাগবে। আসলে সেটি বাড়িয়ে এখন ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ব্যাংক করতে হলে দিতে হবে এক হাজার কোটি টাকার মূলধন। হয়তো কথার কথাই।
৭. বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, উদ্যোক্তাদের অর্থ তাঁদের আয়কর ফাইলে প্রদর্শিত থাকতে হবে, অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা দেওয়া যাবে না, শেষ পাঁচ বছরে ঋণখেলাপি হলে উদ্যোক্তা হতে পারবেন না।
এখন আপনারা যাঁরা কালোটাকার মালিক, তাঁরা প্রশ্ন করতেই পারেন, আপনারা কালোটাকা দিয়ে ব্যাংক করতে পারবেন কি না। আপনাদের জন্য উত্তর হচ্ছে সব সরকারই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। তবে বর্তমান অর্থমন্ত্রী যে বিশেষ কাজটি করেছেন, তা হলো কালোটাকা সাদা করার ধারাটি আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। বহু আগে এটি আইনে ছিল, পরে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তখন এসআরও জারি করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতো। এখন যে কেবল আইনেই ঢুকে গেছে তা নয়, নতুন একটি রক্ষাকবচও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যেকোনো স্থানে রাখা নগদ অর্থও সাদা করা যাবে। আয়কর আইনের ১৯ এএএএএ ধারায় বলা আছে, কালোটাকা সাদা করলে দেশের আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
কর্তৃপক্ষের মধ্যে তো বাংলাদেশ ব্যাংকও পরবে। সুতরাং কালোটাকা দিয়ে ব্যাংক করা যাবে না, তা কিন্তু জোর গলায় আর বলা যাচ্ছে না। আইনের ফাঁক বলে একটা কথা তো আছেই।
৮. এবার নীতিমালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেখানে বলা আছে, ‘তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুমোদন ছাড়া শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে না।’ এটাই কিন্তু সহজে ব্যাংক মালিক হওয়ার উপায়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে বাধ্য। তাদের শেয়ার স্টক মার্কেটে নিয়মিত লেনদেন হয়। আপনার কাজ হচ্ছে সেখান থেকে শেয়ার কেনা।
এতে কষ্ট না করে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। এই যেমন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। তিনি প্রথমে নামে-বেনামে অনেকগুলো কোম্পানি খুললেন। তারপর এসব কোম্পানি শেয়ারবাজর থেকে কিনল পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ২ শতাংশ থাকলে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়া যায়। এভাবে শেয়ার কিনে তারপর একদিন আপনি ব্যাংকের মালিক হয়ে যেতে পারবেন।
তবে এখানে একটু কথা আছে। শেয়ারবাজার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা লাগবে। পিপলস লিজিংয়ের কথাই ধরা যাক। প্রতিষ্ঠানটির আগের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা অনিয়ম করেছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন কেউ থাকতে হবে, যিনি সেই অনিয়ম ধরে সময়মতো আগের পর্ষদ বাতিল করার ক্ষমতা রাখেন। এমন কাউকে বের করা কিন্তু আপনার কাজ। পি কে হালদারের হয়ে কাজ করেন—এ রকম দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিলেন।
আরও কিছু পদ্ধতি আছে। বিস্তারিত জানতে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলের ইতিহাস গুগল করে খুঁজে পড়ে নিতে পারেন।
এ নিয়ে নতুন কোনো প্রশ্ন থাকলে পাঠাতে পারেন আমাদের কাছে।
শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক