কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঘুষকাণ্ড
বিব্রত সাবেক দুই গভর্নর
সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর ও বর্তমান এক নির্বাহী পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারি চাপা দেওয়ার অভিযোগে প্রশ্নের মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা। পাশাপাশি বিদেশ থেকেও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে জানতে চাইছেন। তবে পরিস্থিতি উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘুষ নেওয়ার যেসব ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে, তা বেশ পুরোনো ও বহুল আলোচিত। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার সুবিধা নেওয়ার ঘটনা সবার মুখে মুখে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে ‘ঘুষ’ নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম চাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া পরিদর্শন দলের কর্মকর্তাদেরও টাকা দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী এসব অভিযোগ করেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১০ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজের ধরনে পরিবর্তন আসে। আগে নিচের দিকের কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিষয়ে বিধি মেনে ফাইল প্রস্তুত করতেন, পরে নিয়ম অনুযায়ী সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। ২০১০ সালের পর থেকে ওপরের দিক থেকে আসা নির্দেশ মেনে বিভিন্ন বিষয়ে ফাইল প্রস্তুত শুরু হয়। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্বাহী পরিচালক, ডেপুটি গভর্নর ও গভর্নর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োগ শুরু হয়। মূল সমস্যা শুরু হয় তখন থেকেই, যা এখন সামনে উঠে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘ঘুষ’ গ্রহণের অভিযোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যিনি এসব অভিযোগ তুলেছেন, তিনিও অপরাধী। ফলে তাঁর বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, এটা বড় প্রশ্ন। তবে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ভাবমূর্তি আগে থেকেই খারাপ। এটা সবাই জানে। তাই পুরো দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বর্তাবে।’
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান। তাই এসব বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছি। এই প্রতিষ্ঠানে এখন বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। পুরো আর্থিক খাতেই যে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, এসব অভিযোগ তা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় যদি দক্ষতা ও সততার মাধ্যমে আর্থিক খাত পরিচালনা করত, তাহলে এমন সংস্কার প্রয়োজন ছিল না।’
বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নিয়োগ অনুমোদন, নতুন শাখা খোলা, বড় ঋণ অনুমোদন, ঋণ পুনঃ তফসিলে বিভিন্ন সময় অনৈতিক সুবিধা নেওয়ারও অভিযোগ আছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়ার পর তা চাপা দিতেও বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা খরচ করতে হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। দেশে ও দেশের বাইরে আর্থিক লেনদেনেরও ঘটনা আছে একাধিক।
‘বাংলাদেশ ব্যাংক আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান। তাই এসব বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছি। এই প্রতিষ্ঠানে এখন বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। পুরো আর্থিক খাতেই যে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, এসব অভিযোগ তা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে।মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সম্প্রতি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক বলেন, নানা অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) প্রতি মাসে দেওয়া হতো ২ লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। এ ছাড়া পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে দেওয়া অপর এক জবানবন্দিতে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমসহ অন্যদের পিপলস লিজিং থেকে সাত বছরে (২০০৯-১৫) সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে।
এই অভিযোগের পর শাহ আলমকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই বদলি নিয়মিত প্রক্রিয়া। তদন্ত কমিটি হয়েছে, সেখান থেকে কোনো সুপারিশ এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে গত ১৫ ফেব্রুয়াারি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডে (বিআইএফসি) আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় জড়িতদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কমিটি বিআইএফসির পাশাপাশি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ঘটনাও খতিয়ে দেখবে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হবে। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অনিয়ম–দুর্নীতির কথা আলোচনা হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা একই কারণে আলোচনায়। একজন সাবেক গভর্নর হিসেবে এতে আমি বিব্রত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।’
‘এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অনিয়ম–দুর্নীতির কথা আলোচনা হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা একই কারণে আলোচনায়। একজন সাবেক গভর্নর হিসেবে এতে আমি বিব্রত।সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন ব্যবস্থা যদি ভালো ও স্বচ্ছ থাকত, তাহলে এমন অভিযোগ আসত না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে একক ক্ষমতা দেওয়া কখনোই ঠিক না। এমন প্রথা থাকলে তা ভেঙে দিতে হবে। সবাইকে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিতে হবে। আর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে অন্য কেউ এ ধরনের কাজ করার আর সাহস না করে। না হলে প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।’