ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উত্তেজনা, বিতর্ক
অনুমোদন ছাড়া যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার অনুমোদন চাইলে দুজন পরিচালক তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপরও এসব ঋণ পাস হয়েছে।
পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটি এসব ঋণের অনুমোদন দেয়নি। এরপরও ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা ঋণ বিতরণ করেছেন। এখন এসব ঋণ অনুমোদন করেছে ব্যাংকটি পরিচালনা পর্ষদ, যদিও দুজন পরিচালক প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করেছেন। এ নিয়ে পর্ষদ সভায় কিছুটা উত্তেজনা ও বিতর্ক হয়েছে। ঘটনাটি বেসরকারি খাতের আলোচিত ন্যাশনাল ব্যাংকের, ব্যাংকটির ৪৪৬তম পর্ষদ সভার। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় গত রোববার।
ব্যাংকটির একাধিক পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্ষদ সভায় এসব ঋণ অনুমোদনের পক্ষে ছিলেন ব্যাংকটির পরিচালক রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার। আরও পক্ষে ছিলেন তাঁদের মা ও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার এবং স্বতন্ত্র পরিচালক, সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পর্ষদ সভায় এসব ঋণ অনুমোদনের সময় পরিচালক জাকারিয়া তাহের ও মোয়াজ্জেম হোসেন প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে রন হক সিকদারকে ‘বাবা চুপ করো’ বলেও থামিয়ে দেন চেয়ারম্যান। আর চেয়ারম্যানের মেয়ে ও পরিচালক পারভীন হক সিকদার, অপর পরিচালক মাবরুর হোসেন ছিলেন নিশ্চুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক কাজী রফিকুল হাসান কোনো মন্তব্য করেননি। অবশ্য পর্যবেক্ষকেরা পর্ষদে মতামত দেন না। কোনো আপত্তি থাকলে লিখিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে পারেন।
পরিচালকদের মধ্যে জাকারিয়া তাহের, মোয়াজ্জেম হোসেন, মাবরুর হোসেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক অনলাইনে অংশ নেন। চেয়ারম্যান, তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্বতন্ত্র পরিচালক সভায় যোগ দেন সিকদার পরিবারের ধানমন্ডির বাসা থেকে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যবেক্ষক প্রতিবেদন দিলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। নিশ্চয়ই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পর্ষদ সূত্র জানায়, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গত ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। এরপর পর্ষদ সভা না হলেও ঋণ বিতরণ অব্যাহত ছিল। এ নিয়ে বিশেষ তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অনুমোদনহীন ঋণ বিতরণ আটকে দেয়। পাশাপাশি ঋণ আমানত অনুপাতসীমার মধ্যে না আসা পর্যন্ত ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির জন্য বড় ঋণের সীমাও নতুন করে ঠিক করে দেয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কিছুটা পিছু হটেছে। একটি ব্যাংকের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ন্যাশনাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাপ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত রোববারের সভার শুরুতে ঋণ প্রস্তাব উঠলে মোয়াজ্জেম হোসেন এর বিরোধিতা করেন। তিনি এ সময় টাকা না থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, অন্য ব্যাংক থেকে কল মানিতে টাকা ধার নিয়ে চলছে, এ অবস্থায় ব্যাংক নতুন ঋণ কীভাবে দেবে, এর পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান বলেন, নতুন কোনো ঋণ দেওয়া হচ্ছে না, বরং আগে যা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোই ঠিক করা হচ্ছে।
এ সময় কথা বলেন পরিচালক জাকারিয়া তাহের। তিনি জানান, পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির অনুমোদন ছাড়া যেসব ঋণ গেছে, তার দায়দায়িত্ব তিনি নেবেন না। তিনি আরও প্রশ্ন করেন, এমডি কীভাবে অনুমোদন ছাড়া ঋণ দিলেন।
এ সময় রন হক সিকদার জাকারিয়া তাহেরকে ধমকের সুরে কিছু একটা বলেন। জানা গেছে, এর জবাবে জাকারিয়া তাহের বলেন, ‘আপনি ধমকাধমকি করেন কেন। আমি তো এখানে চাকরি করি না।’
এরপরই মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ব্যাংকের এমডি যেভাবে প্রস্তাব উপস্থাপন করছেন, এসব অনুমোদন হলে সবার নামেই ক্রিমিনাল আইনে মামলা হবে।
সভার একপর্যায়ে রিক হক সিকদার বলেন, ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের কথা বলা হলেও আসলে ২০১৬ সালের পর ১৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ গেছে। তখন তিনি বলেন, ব্যাংকের ভালোর জন্য শুধু ভাষণ দিলে হবে না।
রোববারের পর্ষদ সভায় স্টেপ মিডিয়া, ডাইরেক্ট ফ্রেশ, সাইফ পাওয়ার টেক, সাইফ পাওয়ার হোল্ডিং, সান্ত্বনা এন্টারপ্রাইজ, আরএসএ ক্যাপিটাল, ইকোউড লিমিটেড, এসকর্প অ্যাপারেল (সাবেক বেক্সিমকো অ্যাপারেল), ওয়ার্ল্ড অব ট্রেডিং এবং কর্ণফুলী লিমিটেডের অনুকূলে আগে বিতরণ হওয়া ঋণের অনুমোদন করা হয়। এ ছাড়া দেশ টেলিভিশন, আলেশা মার্ট, ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের ঋণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেলে আবারও পর্ষদে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
গত রোববার পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানত ছিল ৪১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা ও ঋণ ৪০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। যেখানে ঋণ আমানত অনুপাত দাঁড়ায় ৯৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গ্রাহকদের জমা টাকার সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের ১৩ শতাংশ অর্থ বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে রাখতে হয়। তবে রোববারে তাতে ঘাটতি ছিল ৫৩৮ কোটি টাকা।
এ নিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদারের বক্তব্য জানতে টেলিফোন করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।