আর্থিক খাতে এক বছরে ৬৫ শতাংশ বেড়েছে সন্দেহজনক লেনদেন
দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে, গত অর্থবছরে ব্যাংক খাতে ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে এ সময়ে পুরো আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় যা প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংক খাতের বেনামি ও প্রতারণাপূর্ণ ঋণ বন্ধ করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির ‘রোগ’ সারাতে বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই এই চিত্র উঠে এসেছে।
বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের কাছে পাঠানো ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২০, যা এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৪১টি। অর্থাৎ এ ধরনের লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা বেড়ে দেড় গুণ হয়েছে। আর গত অর্থবছরে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, ব্রোকারেজ হাউসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে সব মিলিয়ে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল ১৪ হাজার ১০৬টি, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।
বিএফআইইউ তাদের এই বার্ষিক প্রতিবেদনে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি ব্যাংক খাতে ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্যও প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র মো. সরোয়ার হোসেন এবং বিএফআইইউর উপপ্রধান মো. রফিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনের বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেন সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামাল হোসেন।
বিএফআইইউ অর্থ পাচার রোধে দেশের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। ব্যাংক কর্মকর্তারা যেসব লেনদেনকে সন্দেহজন বলে মনে করেন, সেসব লেনদেনকে তাঁরা ‘সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন’ হিসেবে বিএফআইইউতে পাঠিয়ে দেন। কোনো ছোট গ্রাহকের হিসাবে বড় লেনদেন, কোনো গ্রাহকের একসঙ্গে বড় অঙ্কের নগদ টাকা উত্তোলন, ছোট ব্যবসায়ীর নামে বড় ঋণ, অপরিচিত হিসাবে টাকা স্থানান্তর, সম্পর্ক নেই এমন হিসাবে লেনদেন—ব্যাংকগুলো সাধারণত এসব বিষয়কে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
দেশ থেকে যাঁরা অর্থ পাচার করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা এবং পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কী করা হচ্ছে, অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়, দীর্ঘদিন ধরেই এই অভিযোগ করা হচ্ছে। আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের উঁচু মানের জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ—এসব উদ্দেশ্যে অর্থ পাচার হয় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, টাকা পাচার হচ্ছে বা বেড়েছে, এটা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন বাড়ার চিত্র দেখে বোঝা যাচ্ছে। বিএফআইইউ বলছে, শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। এর মাধ্যমে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে সংস্থাটির। সংস্থাটি যে নখদন্তহীন সিংহ, তা নিজেরাই প্রকাশ করেছে। এ জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রকৃত রাজনৈতিক অঙ্গীকার করতে হবে। এস আলম গ্রুপসহ যাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ উঠেছে, তাদের নিয়ে তদন্ত করতে হবে। প্রকৃত দোষীদের যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
বেড়েছে প্রতিবেদন দাখিল
বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট ১৪ হাজার ১০৬টি সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং বা প্রতিবেদনের মধ্যে ১২ হাজার ৮০৯টি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে, ১২১টি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে, ৯০০টি প্রবাসী আয় সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান এবং ৯০০টি অন্যান্য খাত থেকে এসেছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টিং ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করে বিএফআইইউ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের তৈরি এ রকম ১৩৩টি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে। এর মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) ৮৫টি, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ৩৩টি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ১০টি ও অন্যান্য সংস্থায় ৫টি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে ছিল দুর্নীতি ও ঘুষসংক্রান্ত ৩৩টি, জালিয়াতিবিষয়ক ১৪, প্রতারণাসংক্রান্ত ৪২টি, মুদ্রা পাচার নিয়ে ২০টি, মানব পাচার ও কিডন্যাপ বিষয়ের ৩টি ও অন্যান্য বিষয়ে ছিল ২১টি।
অনুষ্ঠানে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফআইইউর কাছে রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাসমূহের প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) দাখিল প্রায় ৬৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের নেওয়া নানাবিধ অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে আর্থিক ব্যবস্থায় লেনদেন কার্যক্রম বেড়েছে। এর ফলে গত বছরের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নগদ লেনদেন বিবরণীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থ পাচার নিয়ে বিএফআইইউর প্রধান
বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন বিএফআইইউর প্রধান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের বড় অংশ ছিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে ২৬০টি বাড়ির মালিকানা সম্পর্কে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের অর্থ পাচারের অভিযোগ ও অর্থ পাচার রোধে সংস্থাটির ভূমিকা নিয়ে।
সরকারের অনুমোদন ছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী বিদেশে এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন, বিএফআইইউ এ ক্ষেত্রে কী করছে—এই প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বিদেশে যাঁরা জমি-ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাঁদের নিয়ে দুদক কাজ করেছে। ইতিমধ্যে কিছু মামলাও হয়েছে। অন্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।
দেশ থেকে আর কারা অর্থ পাচার করেছেন ও পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনতে কী করা হচ্ছে, এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বিদেশের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে সব সময় তথ্য পাওয়া যায় না। এ জন্য ১০ দেশের সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। দেশ থেকে অর্থপাচারের ৭০–৮০ শতাংশ হয় আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যেম।
এস আলম গ্রুপের অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘এ নিয়ে আদালত থেকে যে নির্দেশনা এসেছে, সেভাবে আমাদের কাজ চলছে।’ তাঁর মতে, দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার ৭০-৮০ শতাংশ হয় বাণিজ্যের আড়ালে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। কোনো অর্থ পাচার হয়ে গেলে ফেরত আনা কঠিন। কারণ, দুই দেশে দুই রকম আইন প্রচলিত আছে। এ-সংক্রান্ত চুক্তি হলে টাকা ফেরত আনা সহজ হতে পারে। এখন পর্যন্ত শুধু আরাফাত রহমান কোকোর টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা চালানো প্রতিষ্ঠান এমটিএফইর বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘জড়িতদের ধরতে আমরা দুবাইয়ের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে অনুরোধ করেছিলাম। জড়িতরা দুবাই থেকে পালিয়ে গেছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। ডিজিটাল প্রতারণা ধরতে আমাদের তেমন সক্ষমতা হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে উন্নতির চেষ্টা চলছে।’
অর্থ পাচারের কারণে ডলার-সংকট বেড়েছে, তাই পাচার রোধে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পক্ষ থেকে বড় ধরনের কোনো ভূমিকা নেওয়া হয়েছে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘কেউ অভিযোগ না করলে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা জানতেও পারি না। আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করছি। আদালত থেকে যেসব নির্দেশনা আসে, তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নিই।’
(তথ্য আরও বেশি সুনির্দিষ্ট করে পুনরায় সম্পাদনার পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে)