দেশের ব্যাংকের আমানতকারীদের ৪১ শতাংশই কোটিপতি
দেশে সরকারি–বেসরকারি, বিদেশি ও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে যত গ্রাহক আমানত রেখেছেন তাঁদের মধ্যে ৪১ শতাংশই এখন কোটিপতি। ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি জমা আছে এ রকম হিসাবধারীর সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ১২৭ জন। তাঁদের হিসাবে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার বেশি জমা আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে। গত জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এর পরের, অর্থাৎ অক্টোবর–নভেম্বর ও চলতি মাসের হিসাবে কিছুটা হেরফের হতে পারে। দেশে এ বছরের শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি হিসাবধারীর চূড়ান্ত হিসাবটি পাওয়া যাবে আরও কয়েক মাস পর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী সব ধরনের ব্যাংকে গত সেপ্টেম্বর শেষে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটিপতিদের হিসাবগুলোতে জমা আছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের প্রায় ৪১ শতাংশ। বাকি ৫৯ শতাংশ বা ১০ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা যাঁদের হিসাবে জমা আছে তাঁদের কেউই কোটিপতি নন। অর্থাৎ তাঁদের প্রত্যেকেরই জমা অর্থের পরিমাণ এক কোটি টাকার কম।
ব্যাংকে জমা অর্থের পরিমাণের ভিত্তিতে ব্যাংক হিসাবগুলোকে ২৪ ভাগে ভাগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকে মোট আমানত হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ২০ লাখ ২৮ হাজার ২৫৫টি। এর মধ্যে ১ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকার কম রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের হিসাব আছে ১১ কোটি ৭৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬১৩টি, যা মোট আমানত হিসাবের প্রায় সাড়ে ৭২ শতাংশ। এসব হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ মাত্র ৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
ব্যাংকে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা জমা রয়েছে, এ রকম হিসাবের সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১ কোটি ৩৩ লাখ ২৪ হাজার ৩১৪টি। এসব হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ ১৭ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সব ধরনের আমানত হিসাবের মধ্যে জমা অর্থের পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ রয়েছে শীর্ষ কোটিপতিদের হিসাবে। এই শ্রেণির প্রতিটি অ্যাকাউন্ট বা হিসাবে ৫০ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা আছে। জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এ রকম ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮০০টি। এই হিসাবগুলোয় জমার পরিমাণ ২ লাখ ৫১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা, আলোচ্য প্রান্তিকে ব্যাংকে জমা আমানতের প্রায় ১৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ জমা আছে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জমা রয়েছে এমন হিসাবে। এ ধরনের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ, যেগুলোতে জমা অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা, যা জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের মোট আমানতের প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের ব্যাংক হিসাব ও সেসব হিসাবে জমা অর্থের যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, তাতে ব্যক্তি পর্যায়ের হিসাব যেমন আছে তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক হিসাবও রয়েছে। এ কারণে ৫০ কোটি টাকার বেশি জমা আছে এমন হিসাবের গ্রাহকদের জমা অর্থই সবচেয়ে বেশি। দেশে বড় বড় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প গ্রুপ রয়েছে, যাদের ব্যাংক হিসাবে শতকোটি টাকার বেশি জমা থাকে। এ কারণে এই ধরনের হিসাবে সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, কোটিপতিদের হাতে যে টাকা আছে তা ব্যাংকে জমা রাখলে তার বিপরীতে চড়া সুদ পান। সেই সুদ জমা হয়ে বছর বছর অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এভাবেই যাঁর হাতে যত বেশি টাকা থাকে তিনি তত বেশি ধনী হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া ধনীদের হাতে নগদ অর্থের পাশাপাশি তাঁদের নামে বাড়ি–জমিসহ অনেক ধরনের সম্পদও থাকে। সেখান থেকেও প্রতিবছর মোটা অঙ্কের অর্থ আয় হয়, যা ঘুরেফিরে ব্যাংকে আসে। ফলে ব্যাংক আমানতে কোটিপতিদের হিস্যা বাড়ছে।
কমেছে অর্ধশত কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, প্রতিটিতে ৫০ কোটি টাকার বেশি জমা এমন গ্রাহকের হিসাব সংখ্যা গত জুনের শেষে ছিল ১ হাজার ৮১৮টি। তখন এই হিসাবগুলোয় জমা অর্থের মোট পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে অর্ধশত কোটি টাকা আছে ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১৮টি কমে ১ হাজার ৮০০টিতে নেমে যায়। পাশাপাশি তিন মাসের ব্যবধানে এসব হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ কমে ২ লাখ ৫১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকায় নামে। অর্থাৎ এ ধরনের হিসাবে তিন মাসে জমা অর্থের পরিমাণ কমেছে ১৭ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক গ্রাহক ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা–বাণিজ্য গুটিয়েছে। এ কারণে অর্ধশত কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব ও সেগুলোতে জমা অর্থের পরিমাণ কমেছে।
শুধু অর্ধশত কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব নয়, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা জমা আছে এ রকম হিসাবের সংখ্যাও কমেছে গত তিন মাসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা গত জুনের শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯৫৩টি। সেপ্টেম্বর শেষে তা কমে হয়েছে ৯২ হাজার ৫৬৩টিতে। এই ধরনের হিসাবে জুনের শেষে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে কমে হয় ১ লাখ ৯৭ হাজার ২১১ কোটি টাকা। তিন মাসে এই শ্রেণির হিসাব কমেছে ১ হাজার ৩৯০টি। আর এই ধরনের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ কমেছে ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা আছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা জুন প্রান্তিকের শেষে ছিল ১২ হাজার ৬৯১টি। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা কমে হয় ১২ হাজার ৬৫৮টি। এই ধরনের হিসাবে জুনের শেষে জমা ছিল ৯০ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে কমে হয় ৯০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে হিসাব সংখ্যা কমেছে ৩৩টি। আর এসব হিসাবে জমার পরিমাণ কমেছে ৩৯১ কোটি টাকা।
একইভাবে ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি, ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটি, ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটি, ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি, ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটি, ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ও সেগুলোতে জমা অর্থের পরিমাণও কমেছে। তবে ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকা জমা আছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ও সেগুলোতে অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। গত জুনের শেষে এ ধরনের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৩৪টি, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬৮টিতে। জুন শেষে এই ধরনের হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৭১ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে এই শ্রেণিতে হিসাব সংখ্যা ৩৪টি, আর জমার পরিমাণ ৮৭৯ কোটি টাকা বেড়েছে।
কোটিপতি হিসাবে হঠাৎ করে জমা অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়ার বিষয়ে আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একটি গোষ্ঠী ব্যাংকের বদলে স্বর্ণ বা মার্কিন ডলার কিংবা নগদ টাকা হাতে রাখছেন। আবার অনেকে হিসাব জব্দ হওয়ার ভয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছেন। যে কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব হিসাবে অর্থের পরিমাণ কমেছে।