ব্যাংক খাতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে, সংকট কাটাতে পথনকশা দরকার

মতিঝিল শাপলা চত্বরফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের অস্থিরতা। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দাবির মুখে সরে গেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রায় পুরো নেতৃত্ব; দাবি উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তনেরও। এসব ব্যাংকে মালিকানা পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে ভেতর ও বাইরে থেকে। এ কারণে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে।

পরিস্থিতি নিয়ে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। তাঁদের পরামর্শ, দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করে আর্থিক খাতকে বর্তমান সংকট থেকে বের করে আনতে হবে এবং এর ভবিষ্যৎ গতিপথ ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংক অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হলে সরকারকে সে পথেও হাঁটতে হবে।

বর্তমান সংকটের শুরু ইসলামী ব্যাংক থেকে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিনই ইসলামী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারী ২০১৭ সালের মালিকানা পরিবর্তনের পর নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কারের দাবি তোলেন। ওই বছরই ব্যাংকটি রীতিমতো দখল করে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ।

এর মধ্যে ৭ আগস্ট নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারী গভর্নরের ফ্লোরে গিয়ে দাবি করেন যে গভর্নর, চার ডেপুটি গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা ও আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানদের পদত্যাগ করতে হবে। তাঁদের দাবির মুখে ছয় শীর্ষ কর্মকর্তা ‘পদত্যাগ’ করেন, পরে অবশ্য একজন ডেপুটি গভর্নরকে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা সাময়িকভাবে দায়িত্বে থাকার ‘অনুমোদন’ দেন।

ইসলামী ব্যাংকের সংকটকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত রক্ত ঝরেছে। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ কেউ গতকাল রোববার ব্যাংকে ঢুকতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। ঘটে সংঘর্ষ আর গুলির ঘটনা।

বেসরকারি খাতের আরেক ব্যাংক আইএফআইসির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপদেষ্টাসহ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর প্রতিনিধিত্বকারী সবাইকে সরে দাঁড়াতে বলেছেন আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মীরা। অস্থিরতা চলছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকেও।

এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, বিতর্ক যাঁর কখনো পিছু ছাড়েনি। ফলে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কার্যত এখন নেতৃত্বশূন্য।

আওয়ামী লীগের একের পর এক ভুল নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক খাতের এই অস্থিরতা। ফলে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি কেবল নাজুকই হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতকে বের করে আনতে হলে সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে হবে এবং এ কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোয় যে ভঙ্গুর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার বিস্তৃতি কতটা, তা জানতে নিরীক্ষা করা দরকার। এর ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে, এসব ব্যাংকের সংস্কার কীভাবে হবে এবং শেষ পর্যন্ত এগুলোর দায়দায়িত্ব কার ওপর দেওয়া হবে।

ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোয় যে ভঙ্গুর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার বিস্তৃতি কতটা, তা জানতে নিরীক্ষা করা দরকার
এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের হাতে থাকবে না—অর্থ উপদেষ্টার উচিত এমন ঘোষণা দেওয়া। এ ছাড়া কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া ব্যাংক, যেমন পদ্মা ব্যাংক—এমন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ লাগবে। এসব ব্যাংক সরকার সীমিত সময়ের জন্য অধিগ্রহণ করতে পারে কিংবা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে পারে।

এই অর্থনীতিবিদ অবশ্য মনে করেন যে এসব সিদ্ধান্ত হবে ‘নৈতিক ও অর্থনৈতিক’ এবং কোনোভাবেই তা ‘রাজনৈতিক’ হবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কেউ যদি ভালোভাবে ব্যাংক পরিচালনা করেন, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। মূল বিবেচ্য বিষয় হবে, মালিকেরা কীভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, সার্বিকভাবে তহবিলের ঘাটতি ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত করতে হবে। একটি কমিশন গঠন করে ব্যাংক খাতের সংস্কার করা দরকার। প্রয়োজনে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।

ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি কমিশন করা যেতে পারে বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি নূরুল আমিনও। তিনি বলেন, কমিশন গঠন হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি একটি পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে ব্যাংক খাতে যে সংস্কার কার্যক্রম দরকার, তা নিরূপণ করা হবে।

তবে আশু পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, সুশাসন নিশ্চিত করা, নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়া ও আস্থার ঘাটতি দূর করার পরামর্শ দেন নূরুল আমিন। তিনি আরও বলেন, এসব পদক্ষেপ নিতে পারলে ব্যাংক খাতে দৃশ্যমান উন্নতি হবে।