বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আবদুল হাই কোথায়, দুদকও জানে না
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই কোথায়, সে তথ্য কেউই বলতে পারছেন না।
দুর্নীতির মামলা হওয়ার আট বছর পর বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর নাম দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগপত্রে আসার খবরে সবারই প্রশ্ন, তিনি এখন কোথায়। ঢাকায় না গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে? নাকি নিয়মিত যাতায়াত করা সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন? নাকি অনেকের মতো স্থায়ী আবাস গড়েছেন কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রে?
দুদকের কাছে এসব প্রশ্নের জবাব চেয়ে পাওয়া যায়নি। মোট ৫৯টি মামলার মধ্যে ৫৮টিতে ১৪৫ আসামির তালিকায় নাম রয়েছে আবদুল হাইয়ের। কয়েক দিনের মধ্যেই দুদক অভিযোগপত্রগুলো আদালতে দাখিল করবে। আবদুল হাইকে আসামি করলেও দুদক কি শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধরবে? যদি বিদেশে পালিয়ে থাকেন, বিদেশ থেকে ফিরিয়ে দেশে এনে দুদক কি বিচারের মুখোমুখি করবে আবদুল হাইকে? এসব প্রশ্নেরও জবাব মিলছে না কোথাও।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর আগেও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইয়ের তথ্য আমাদের কাছে ছিল। তবে এখন তিনি কোথায় আছেন, তা বলা যাচ্ছে না। অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার পর আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমরা মনে করছি।’
এক বছর আগেও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইয়ের তথ্য আমাদের কাছে ছিল। তবে এখন তিনি কোথায় আছেন, তা বলা যাচ্ছে না।মো. মোজাম্মেল হক খান, দুদক কমিশনার
অনেকেই বলছেন যে শেখ আবদুল হাই বিদেশে চলে গেছেন—এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরই দুদক তাঁর নাম অভিযোগপত্রে এনেছে। মোজাম্মেল হক খানকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মোটেও তা নয়। তবে এটা যদি সত্যও হয়, তাঁকে আসামি করার কারণে দুদক ধন্যবাদ পেতে পারে। কারণ, বিদেশে চলে গেলেও তিনি আর ফিরতে পারবেন না। ফিরলেই গ্রেপ্তার হতে পারেন। তবে তাঁর আইনগত সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। যদি আদালতে প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি নির্দোষ, তাহলে তো কথা নেই।’
শেখ আবদুল হাই এখন কোথায়, তা জানতে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ঢাকায় তাঁর দুটি বাড়িতে গিয়ে সরেজমিনে খোঁজ নেওয়া হয়। একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সুজিত দেবনাথ জানান, তিনি পাঁচ বছর ধরে এ বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একবারের জন্যও এখানে তাঁকে আসতে দেখেননি।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ১০ বছর আগে ১১০ কোটি টাকায় দেড় বিঘার একটি বাড়ি কিনেছিলেন শেখ আবদুল হাই। নামে-বেনামে যেসব লোককে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেসব ঋণের একটা অংশ তিনি ও তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই উঠে আসে। গতকাল সেই বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তিনি এখানেও থাকেন না। বাড়িটি কেনা হয় আবদুল হাই, তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও ভাইয়ের নামে।
বেসিক ব্যাংকের ২০১০-১৩ সময়ের ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর ২০১৪ সালে বিশেষ নিরীক্ষা করেছিল বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে ব্যাংকটিতে নজিরবিহীন অরাজকতার ঘটনা ঘটেছে ১১১টি, যেগুলোতে জড়িত ৫ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। দুদক অবশ্য ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছে।
‘একটা ভালো ব্যাংক একজন ব্যক্তির হাতে পড়ে কীভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তার বড় উদাহরণ বেসিক ব্যাংক। ব্যাংক খাত তথা অর্থনীতির স্বার্থেই উচিত হবে ব্যাংকটিকে নষ্ট করার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।আনিস এ খান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি
কে এই আবদুল হাই
ছিলেন সামান্য একজন ব্যবসায়ী। পরে এরশাদের সময়ে হন জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা। সেখান থেকে আবদুল হাই পরে কীভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন এবং বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদটি পেয়েছিলেন, সে রহস্যের সন্ধান এখনো মেলেনি।
জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে অংশ নিয়ে তিনি সাংসদ হয়েছিলেন। ওই সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ১৯৮৮ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। একই সময় তিনি ছিলেন বাগেরহাট জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি।
বাগেরহাটের সাধারণ লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এইচ এম এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও তিনি জাতীয় পার্টির (মঞ্জুর) প্রয়াত চেয়ারম্যান ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুরের ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে চলতেন।
শেখ আবদুল হাই বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার আডুয়াডিহি গ্রামের পুলিশের প্রয়াত উপপরিদর্শক শেখ আবদুল হামিদের পুত্র। ছাত্রজীবনে তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে এলাকাবাসী শোনেননি। এরশাদের পতনের পর তাঁকে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতেও দেখেননি এলাকাবাসী।
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবদুল হাই থাকতেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ক্যান্টনমেন্টে যাঁদের বাসা রয়েছে, তাঁদের একটি সমিতি রয়েছে। সেই সমিতির দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। পদাধিকারবলে সমিতিটির সভাপতি সেনাবাহিনীর প্রধান। সে হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ ছিলেন ওই সমিতির সভাপতি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার ৯ মাস পর আওয়ামী লীগ দলীয় লোকদের বিভিন্ন ব্যাংকে চেয়ারম্যান-পরিচালক নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিন বছরের চুক্তিতে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ পান আবদুল হাই। এর আগে সব সময়েই শিল্পসচিব পদাধিকারবলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হতেন। শেখ আবদুল হাই চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই ডুবতে থাকে বেসিক ব্যাংক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা ছাড়াই তিনি ব্যাংক চালাতে থাকেন। ঋণ বিতরণ থেকে শুরু করে লোক নিয়োগ, পদোন্নতি—কোনো কিছুতেই আইন মানেননি তিনি।
সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন বলে সব জায়গায় একটি আবহ তৈরি করে রাখতেন তিনি। এ কারণেই এত সব অনিয়ম-দুর্নীতি সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে এত দিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকারি কোনো সংস্থা।
গণমাধ্যমে তাঁর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরও সরকার ২০১২ সালে তাঁকে আবারও চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় দুই বছরের জন্য। তাঁর দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি ২০১৪ সালের জুলাইয়ে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় গিয়ে পদত্যাগ করেন।
বাগেরহাটের স্থানীয় লোকেরা জানান, একসময় গাড়ির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন আবদুল হাই বাচ্চু। সরকারি-বেসরকারি অফিসে লিফট স্থাপনের ব্যবসাও ছিল তাঁর। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই তাঁর আর্থিক অবস্থা দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে।
এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ২০১১ সালে মাছ ধরার ট্রলার ব্যবসায় নামেন তিনি এবং দুই বছরের কম সময়ে ১৫০ কোটি টাকা দামের ১১টি ট্রলারের মালিক হন। বিএম কম্পিউটারস, ক্রাউন প্রোপার্টিজ এবং ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড—তাঁর মালিকানাধীন তিনটি কোম্পানি।
ব্যক্তিগত জীবনে আবদুল হাই স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। তাঁর অন্য ভাই-বোনেরা হলেন শেখ ওয়াহিদুজ্জামান, শেখ খালেকুজ্জামান, শেখ শাহরিয়ার পান্না, শেখ সায়িদা ভুলু, শেখ মমতাজ রুমি, শেখ শিউলি ও শেখ জনি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা ভালো ব্যাংক একজন ব্যক্তির হাতে পড়ে কীভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তার বড় উদাহরণ বেসিক ব্যাংক। ব্যাংক খাত তথা অর্থনীতির স্বার্থেই উচিত হবে ব্যাংকটিকে নষ্ট করার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। তবে যে কারণেই হোক, দুদক যে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যানকে আসামি করেছে, তা ইতিবাচক। আমরা এখন দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে পারি।’