বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ
ব্যাংক তদারকির ‘নতুন ব্যবস্থায়’ গলদ
সমন্বয়ক জানার আগেই ব্যাংকের পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঋণের টাকা তুলে নিয়েছে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান।
দেশের দুর্বল মানের পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য ব্যাংকগুলোতে সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যোগ দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন সমন্বয়ক নিয়োগের কারণে ব্যাংকগুলো থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে পর্যবেক্ষক। কিন্তু সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকগুলোতে তদারকি বাড়ানোর যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, সেটির কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিযুক্ত পর্যবেক্ষকেরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশ নিয়ে পর্ষদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজেদের মতামত দিতে পারতেন। কিন্তু সমন্বয়কদের ক্ষেত্রে পর্ষদ সভায় অংশ নেওয়ার বিধানটি রাখা হয়নি। ফলে পর্ষদের সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারছেন না সমন্বয়কেরা। শুধু সভার সিদ্ধান্ত কার্যবিবরণী আকারে অনুমোদনের পর পাঠানো হয় সমন্বয়কের কাছে। এর ফলে সমন্বয়ক জানার আগেই পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঋণের টাকাও তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
পর্যবেক্ষক বা সমন্বয়ক মতামত দেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, এমন নিয়ম করতে হবে। তাহলেই এমন উদ্যোগের সফলতা আসবে। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর
এ অবস্থায় সমন্বয়কের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসরকারি খাতের যে পাঁচটি ব্যাংকের পর্যবেক্ষক সরিয়ে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘সমন্বয়কেরা ব্যাংকগুলোর সবকিছু দেখছেন। ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি উন্নতিতে তাঁরা ভূমিকা রাখবেন, এমনটাই প্রত্যাশা। তবে পর্ষদ সভায় যোগ দেওয়া সমন্বয়কদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজন মনে করলে তাঁরা যোগ দিতে পারেন।’
পর্যবেক্ষক থেকে সমন্বয়ক
রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলো সংস্কারে বিশ্বব্যাংক ২০০৪ সালে বিশেষ কর্মসূচি নেয়। এর আওতায় ব্যাংকগুলোকে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। এরপর ব্যাংকগুলোর সূচকের উন্নতি করতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁরা ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও নিরীক্ষা কমিটির সভায় অংশ নিতে পারতেন। এমনকি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভিন্নমত দেওয়ার সুযোগও ছিল। সভার সিদ্ধান্তও পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতেন। তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে সেগুলো হলো এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ১২ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দিয়েই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পৃথকভাবে তদারকির উদ্যোগ নেন। গত ৩ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের অগ্রগতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবেন। এরপর এবি, ওয়ান, ন্যাশনাল, পদ্মা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে পর্যবেক্ষক সরিয়ে সমন্বয়ক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সমন্বয়ক জানার আগেই টাকা উত্তোলন
গত ২৮ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংক পর্ষদের ৪৭৫তম সভায় ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ঋণ নবায়নের প্রস্তাব ওঠে। প্রস্তাবে বলা হয়, সীমাতিরিক্ত ৪৭ কোটি ৮৫ লাখ ঋণপত্র খোলা হয়েছে। অন্য ব্যাংকের এই গ্রাহকের ঋণ খেলাপি অবস্থায় রয়েছে। ঋণ নবায়ন হলে গ্রাহক ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলনের সুযোগ পাবেন।
এ জন্য পর্ষদের আলোচ্যসূচি দেখেই ২৭ ডিসেম্বর ব্যাংকটিতে নিযুক্ত পর্যবেক্ষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম আপত্তি জানিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নাইমুজ্জামান ভূঁইয়াসহ ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ই-মেইলে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ঋণ নবায়নের বিষয়ে আপত্তি জানান।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার অসুস্থতায় আমেরিকায় হাসপাতালে ভর্তি, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভিন হক সিকদারও সভায় যোগ দেননি। অন্য পরিচালকদের উপস্থিতিতে ২৮ ডিসেম্বরের সভায় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ব্যাংকটির পরিচালক রিক হক সিকদার। সভায় ব্যাংটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়কের আপত্তির কথা জানালেও তা অনুমোদন হয়ে যায়। সেদিনই গ্রাহক গুলশান করপোরেট শাখা থেকে ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা নগদ তুলে নেন।
গ্রাহকের হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২৮ ডিসেম্বর চার দফায় ৫ কোটি টাকা করে ও এক দফায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা তোলা হয়।
ব্যাংকটির সভায় ঋণটি নবায়নের বিষয়টি সমন্বয়ক জানতে পারেন সভার কার্যবিবরণী হাতে পাওয়ার পর। তার আগেই ঋণের টাকা তুলে নেন গ্রাহক। তাই সমন্বয়কের এ ক্ষেত্রে কার্যত কিছুই করার ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক এ নিয়ে বলেন, ‘সমন্বয়ক জানার আগে টাকা তুলে নিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা আছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার।’
তদারকি জোরদারের তাগিদ
ব্যাংক খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরালো করার বিকল্প নেই বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ব্যাংক খাতের বড় কয়েকজন গ্রাহক ও ব্যাংকমালিকের মতের বাইরে যেতে পারছে না সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে, তাতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসন শক্তিশালী করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো ঠিক করতে পর্যবেক্ষক মডেলটাও কাজে দেয়নি। একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পর্যবেক্ষক পর্ষদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপত্তি জানালে উল্টো পর্যবেক্ষককেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। চেয়ারম্যান ঠিকই বহাল আছেন। পর্যবেক্ষক বা সমন্বয়ক মতামত দেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, এমন নিয়ম করতে হবে। তাহলেই এমন উদ্যোগের সফলতা আসবে।
এদিকে আইএমএফের দেওয়া শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যাংক খাতের সংস্কার। এ জন্য নানা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে বলেছে আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার কাজ চলছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে।