নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হয়েছে, বাড়বে সব ধরনের সুদ
গত ১৩ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি আরও সংকোচনমূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। এর ফলে সব ধরনের সুদের হার বেড়ে যাবে এবং ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নীতি সুদহার করিডর পুনর্নির্ধারণ–সংক্রান্ত এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আজ রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির এক সভায় ওভারনাইট রেপো নীতি সুদহার বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিদ্যমান নীতি সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে নতুন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার লক্ষ্যে নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুদহার ১০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশে এবং নিচের সীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৭ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে।
সুদের হার বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত আগামী মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।
দেশে গত ১৩ বছরের মধ্যে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার তথ্য প্রকাশিত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে । গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এরপর গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি আবার দুই অঙ্কের ঘর ছাড়ায়।
গত জুলাই মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে। বিবিএসের হিসাবে, জুনে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই এক মাসের ব্যবধানে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশ অনেকটা বেড়ে যায়। জুলাইয়ে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির যে হার দাঁড়িয়েছে, তা গত ১৩ বছর ৪ মাস বা ১৬০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ সর্বোচ্চ খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে, ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এরপর আর কখনো খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশে ওঠেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার সর্বশেষ গত ৮ মে বাড়িয়েছিল। তখন মুদ্রানীতি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়। একই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি স্মার্টও (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) বাতিল করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন জানিয়েছিল, ব্যাংকঋণের সুদহার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক করার লক্ষ্যে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নীতি সুদহার বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে, বাজারে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতির সূচক বাড়ছে, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে তারা। নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহারও বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে উদ্যোগ, বাজারে তার প্রভাব পড়তে সময় লাগে। বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘সুদের হারের সাথে সাথে করছাড় এবং বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহে ঘাটতির বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা দরকার। এসব সংস্থা একসাথে বসে দেখুক, বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না।’