আসছে ডলারের দাম নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি, নতুন মুদ্রানীতিতে আর যা থাকছে

বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: সংগৃহীত

উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধে ঋণের সুদহার আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ডলারের দাম নির্ধারণে চালু হতে পারে ‘ক্রলিং পেগ’পদ্ধতি। আজ জানুয়ারি-জুন মেয়াদের জন্য নতুন মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ঘোষণা দেবে বলে জানা গেছে। বেলা ৩টায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বলে কথা রয়েছে।

মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকার সংকট, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা এবং ব্যাংক খাতে নিয়ন্ত্রণহীনতা—মোটাদাগে এগুলো হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যা। এসব সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের চাপের কারণে ব্যাংক খাত তদারকিতে পুরো ভূমিকা রাখতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ। গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে ও আগামী জুনের মধ্যে তা ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ ও সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল।

মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নীতি সুদের হারও বাড়িয়েছে। এতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

তবে একই সঙ্গে তারল্যসংকট ও উচ্চ সুদহারের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

তবে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতি রোধে নীতি সুদহার আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর লক্ষ্য, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা।

ডলারের বিনিময় হার

দেশে দেড় বছর ধরে ডলার-সংকট চলছে। ফলে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। তবে বাজারে লেনদেন হচ্ছে ১২০ টাকার বেশি দামে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবের পাশাপাশি আর্থিক হিসাবও এখন ঘাটতিতে রয়েছে। গত ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। ডলার-সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্ধেকের বেশি কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী, এখন রিজার্ভ ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম।

এ জন্য ডলার-সংকট ও ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা রোধে ‘ক্রলিং পেগ’ নামে নতুন পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে টাকার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি চালু হবে। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এখানে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। জানা গেছে, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কোস্টারিকাসহ কিছু দেশ এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে।

আরও পড়ুনঃ

নতুন বছরের প্রথম ১২ দিনে এসেছে ৯১ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়

ডলার বন্ডের সুদহার বাড়ানো হয়েছে

২ বছরে ২৪ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেলেও তেমন বাড়েনি প্রবাসী আয়

বেড়েছে খেলাপি ঋণ

তদারকিতে দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এক ডজনের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে মোট ঋণের ৩০ শতাংশে উঠেছে। পাশাপাশি শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকে, চলতি হিসাবেও ঘাটতি রয়েছে তাদের।

অন্যদিকে কিছু ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম ধরায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের বদলি করার ঘটনাও ঘটছে। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে, জানা গেছে, তা হবে সংকোচনমূলক। এই মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্য হবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা কমানো। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে উচ্চ সুদহার বহাল রাখার বিষয়টি মাথায় রেখেই নতুন মুদ্রানীতি তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি নীতি-কৌশলের পাশাপাশি আগে নেওয়া বাইরের বিশেষজ্ঞদের মতামতকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মত হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার।