রিজার্ভ ও ডলার সংকট কাটছে, বছরের শেষে খানিক স্বস্তি

মার্কিন ডলারছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের দাম আটকে রেখে স্থানীয় টাকাকে শক্তিশালী দেখানো হয়। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে গিয়ে আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এ সময় বাধ্য হয়ে ডলারের দাম কিছুটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তাতে দুর্বল হতে শুরু করে টাকা। ফলে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। আর ডলার বিক্রি করায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে অর্ধেক হয়ে যায়। দুই বছর ধরে ডলারের সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলারের বাজার নিয়ে গত সরকারের সময়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা না করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মৌখিক অনুমোদন নিয়ে ডলারের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ফলে সংকট না কেটে; বরং বেড়ে যায়।

সরকার বদলের পর আহসান এইচ মনসুর নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি ডলারের দাম ১২০ টাকা নির্ধারণ করেন এবং তা আড়াই শতাংশ পর্যন্ত কমবেশি করার সিদ্ধান্ত দেন। এতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে ডলারের বাজার। এদিকে প্রবাসী আয়ও বাড়ে। এতে রিজার্ভের পতন থেমেছে, এখন তা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামনে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।

বাড়ছে প্রবাসী আয়

ডলারের জোগান বাড়ানোর অন্যতম উপায় হলো প্রবাসী আয় বাড়ানো। কারণ, প্রবাসী আয় হলো দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না অথবা কোনো দায়ও পরিশোধ করতে হয় না। রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। অন্যদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশে ডলারের মজুতও দ্রুত বাড়ে।

ডলারের দাম নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। এটি বাজারের ওপর থাকলে এখন মূল্যস্ফীতির এত চাপ নিতে হতো না। রিজার্ভ ও প্রবাসী আয় নিয়েও এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না।
মোস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক

গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রবাসী আয় বেড়েছে। প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। তবে চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৮ দিনে বৈধ তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ২৪২ কোটি ১০ লাখ ডলার। প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। শেষ তিন দিনসহ এই মাসে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন ব্যাংকাররা।

বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

প্রবাসী আয়ের জোরালো প্রবাহের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুত বা রিজার্ভ গতকাল রোববার পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬১০ কোটি ডলার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ১৩৪ কোটি ডলার। দীর্ঘদিন পর বিপিএম৬ হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পুরোনো আমদানি দায় পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে। এ কারণে অনেক ব্যাংক বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ডলার কিনছে। ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে আগের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন।

বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানেরা জানান, তাঁরা ১২৩ টাকার বেশি দামে প্রবাসী আয়ের ডলার না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাংকগুলোকে এ রকম নির্দেশনা দিয়েছে। ডলারের ক্রয়মূল্য ১২৬-১২৭ টাকায় ওঠার পর এ সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকগুলো। কারণ, ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত দামে ডলার কেনায় তাদের কাছ থেকে আমদানিকারকদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে পণ্য আমদানির খরচ বাড়ছে।

দেশে গত দুই বছর ডলারের বাজারে অস্থিরতা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিনিময় হার নিয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ডলারের বাজার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

কমছে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা

ডলার–সংকট মেটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এ ঋণের শর্ত হিসেবে বেশ কিছু সংস্কারের পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও মানদণ্ড পরিপালনের শর্ত দেয় সংস্থাটি। ডলার–সংকটের মধ্যে এখন আইএমএফ মিশন আগামী বছরের জুনে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি কমাতে রাজি হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদে ঋণের কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়ার সময় লক্ষ্য কমানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।

আগামী ২০২৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ন্যূনতম ১৯ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। সেটি কমিয়ে এখন ১৭ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে নির্ধারণ করা হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বরের শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। তবে এখন ১৫ বিলিয়নের ঘরে রয়েছে। এটাকে আইএমএফের কিস্তি ছাড়ের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।

বাংলাদেশের অনুরোধে আগামী মার্চ ও জুনে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমাচ্ছে আইএমএফ। সে অনুযায়ী ২০২৫ সালের মার্চের শেষে ১৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে। আগে এ সময়ের জন্য নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। এটি বাজারের ওপর থাকলে এখন মূল্যস্ফীতির এত চাপ নিতে হতো না। রিজার্ভ ও প্রবাসী আয় নিয়েও এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না।