আগামী ছয় মাসের মুদ্রানীতি আজ সোমবার ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে আগামী ছয় মাসের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রাখার দিকনির্দেশনা থাকবে। সেখানে আপনার স্বার্থও জড়িত। আপনার জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে নাকি কমবে, তা বুঝতে পারবেন। আবার কর্মসংস্থানের সুযোগ কতটা বাড়বে, এর দিকনির্দেশনাও পাবেন। উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ কতটা ব্যয়বহুল হবে, তা জানতে পারবেন।
এবার দেখা যাক মুদ্রানীতির আদ্যোপান্ত কেমন।
মুদ্রানীতি কী
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যে নীতি গ্রহণ করা হয়, তাকে মুদ্রানীতি বলে। মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে ওই দেশের সর্বোচ্চ আর্থিক কর্তৃপক্ষ। সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে।
বাংলাদেশে প্রতি ছয় মাস পরপর মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাধারণত জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর—এই সময়সীমা ধরে বাংলাদেশে মুদ্রানীতি দেওয়া হয়।
মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা। এ জন্য দেশের আর্থিক খাতের চিত্র কেমন হবে—এ নিয়ে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য নীতি ঠিক করা হয়। বাজারে মুদ্রার সরবরাহ পরিস্থিতি দিয়েই মূলত এটি ঠিক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মুদ্রানীতির ইতিহাস
২০০৬ সালে বাংলাদেশ প্রথম মুদ্রানীতি দেওয়া হয়। তখন বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করত বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেন। পরের কয়েক বছর এমনই ছিল। পরে ২০২৩ সাল থেকে আবার বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার রীতিতে ফিরে যায় বাংলাদেশ।
তবে বিশ্বে মুদ্রানীতি প্রণয়নের ধারণাটি বেশ পুরোনো। ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আর্থিক সরবরাহব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি ঠিক রাখার জন্য মুদ্রানীতি দেয়। এ থেকে মুদ্রানীতির ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়।
মুদ্রানীতিতে যা থাকে
বাংলাদেশের মুদ্রানীতিতে আগামী ছয় মাসের জন্য নেওয়া বেশ কিছু নীতির প্রতিফলন থাকে। পরের ছয় মাসে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কত, তা মুদ্রানীতিতে ঘোষণা করা থাকে। এ জন্য ওই সময়ে নীতি সুদের হার কত থাকবে, এর দিকনির্দেশনা থাকে। আবার সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কত হবে, তা–ও ঠিক করে দেওয়া হয়।
সার্বিক পরিস্থিতি অনুসারে মুদ্রার সরবরাহ কেমন হবে, এর দিকনির্দেশনা থাকে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে খোলাবাজার কার্যক্রম, সংবিধিবদ্ধ জমার অনুপাত পরিবর্তনসহ সুদহার পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তথা মুদ্রার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেওয়া হয় মুদ্রানীতিতে। রিজার্ভ মানি বা টাকা ছাপানো হবে কি না, এর প্রতিফলন থাকে।
নীতি সুদহার কীভাবে কাজ করে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই হচ্ছে নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। এটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই তারল্য তুলে নেয়। এ জন্যও একটি নির্দিষ্ট সুদহার থাকে। অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদের হার দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। সাধারণত নীতি সুদহার বা রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপোর সুদহার কম থাকে।
নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। সুদ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম ঋণ নেবে। ব্যাংক ঋণ কম নিলে মানুষও কম ঋণ পাবে। ফলে বাজারে টাকার সরবরাহ কম থাকবে। বাজারে টাকার সরবরাহ কম থাকলে জিনিসপত্রের দাম বেশি বাড়তে পারে না।
জীবনে মুদ্রানীতির প্রভাব
সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মূল্যস্ফীতি। আয়ের সঙ্গে সংগতি না রেখে খরচ বেড়ে গেলে অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের কষ্ট বাড়ে। এ জন্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। মানুষের অপ্রয়োজনীয় ভোগকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আগের চেয়ে সুদের হার বাড়িয়ে ঋণের খরচ বাড়ানো হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হন। আমদানি খরচও বাড়ে। আবার বিলাস পণ্যে এলসি মার্জিন বাড়িয়েও পণ্য আমদানির রাশ টানা হয়। ফলে ভোগের চাহিদাও কমবে। বাজারে গিয়ে আপনি বিলাস পণ্যের দাম বেশি দেখলে কিনতে নিরুৎসাহিত হবেন।
তাই মুদ্রানীতিতে সুদের হার, মূল্যস্ফীতির হার—এসব কমানো বা বাড়ানো হলো কি না, এর ওপর মানুষের জীবনধারণ কতটা স্বস্তির হবে, তা বোঝা যায়। মনে রাখতে হবে, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ দিয়ে এ দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন। ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি আছে।
সুদের হার বাড়ানোর অসুবিধাও আছে। সুদের হার বাড়ানো হলে প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়তে পারে। ঋণের সুদের হার বেড়ে গেলে উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ বা নতুন প্রতিষ্ঠান করতে উৎসাহিত হবেন না। এ কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। সাধারণ মানুষের চাকরি বা কাজ কম পাবেন। এতে বেকারত্ব বাড়বে। কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়।
মুদ্রানীতির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, আগের ছয় মাসের তুলনায় পরের ছয় মাস বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানো হয়। এর মানে, সরকার বেসরকারি খাতে ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চায়। এতে শিল্পকারখানার জন্য ঋণ কম যায়। বিনিয়োগ কমে যায়। এ কারণে তা জিডিপি প্রবৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ আটকে দেয়।
আবার ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। তাই বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ল নাকি কমল, এর ওপর সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি অনেকাংশে জড়িত।
সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ফলেও বেসরকারি খাতে ঋণের ওপর প্রভাব পড়ে। বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের জোগান দিতে ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে সরকারকে বেশি ঋণ দেওয়া হয়। ফলে বেসরকারি খাত ঋণ কম পায়। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত না হওয়ায় ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নেয়। এটি শেষ পর্যন্ত প্রথমে উদ্যোক্তা, পরে মানুষের ওপর চাপ বাড়ায়।