কাগুজে টাকাবিহীন সমাজ
ডিজিটাল লেনদেনে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য
গ্রামে টাকা পাঠানো, গ্যাস–বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, ঋণ—সবকিছুই এখন ব্যাংকের কার্ডে ও মুঠোফোনে।
ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সেই ভোগান্তির কথা ভুলে যাননি বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘ব্যাংকে গিয়ে দেখতাম ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষ লাইনে। ওদিকে অফিসে যাওয়ার তাড়া।’
সাইফুল এখন মুঠোফোনেই বিদ্যুৎ বিল দেন। মুঠোফোনে টাকা ভরতেও তিনি দোকানে যান না। মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) অ্যাপ থেকে টাকাটা ভরে নেন। অ্যাপে টাকা ভরা যায় ব্যাংকের কার্ড দিয়ে।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের কেনাকাটা, নিজের গাড়িচালকের বেতন পরিশোধ, জাকাতের টাকা দেওয়া—সবকিছুই সাইফুল করছেন এমএফএস অ্যাপ ও ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা এখন আর ভাবতেও পারি না।’
সাইফুল ইসলাম একজন সচ্ছল মানুষ। রিকশাচালক গিয়াস উদ্দিন অসচ্ছল। তবে তাঁর জীবনও সহজ করেছে ডিজিটাল লেনদেন। গিয়াসের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে সেখানে থাকে। তিনি ১৭ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান।
গিয়াস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে টাকা পাঠাতে হলে খোঁজ রাখতে হতো কে বাড়ি যাবে। আমি থাকতাম এমন লোকের খোঁজে। আর স্ত্রী থাকত টাকার অপেক্ষায়।’ তিনি বলেন, এমনও হয়েছে, যে লোকের কাছে তিনি টাকা পাঠিয়েছেন, তিনি টাকা পৌঁছে না দিয়ে খরচ করে ফেলেছেন।
গিয়াস এখন স্ত্রীর মুঠোফোনে যখন–তখন টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পাঠানোর পর স্ত্রীর ফোন আসে। সঙ্গে সঙ্গে জেনে যান স্ত্রী টাকা পেয়েছেন। মেয়েদের খোঁজও নেওয়া হয়। গিয়াসের কাছে জানতে চাইলাম, জীবন কি সহজ হয়েছে? হেসে উত্তর দিলেন, ‘হইছে তো।’
ঢাকা থেকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে যেমন ক্ষণিকের মধ্যেই টাকা চলে যাচ্ছে, তেমনি দূরের দেশ থেকে এখন টাকা চলে আসছে বাংলাদেশে। মানুষ কেনাকাটা করছে, বিল পরিশোধ করছে; প্রতিষ্ঠান সেই টাকা পেয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন দিচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ডিজিটাল ব্যবস্থায়—ব্যাংকের কার্ড, অ্যাপ ও মুঠোফোনের মাধ্যমে। মাসে এ ব্যবস্থায় লেনদেনের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা।
ডিজিটাল লেনদেন হচ্ছে নানামুখী ব্যবস্থায়—ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড; বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মতো এমএফএস; ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অ্যাপে লেনদেন, ডিজিটাল ব্যবস্থায় তহবিল স্থানান্তর (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার), তাৎক্ষণিক লেনদেন সম্পন্ন করা বা রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট ইত্যাদি। কার্ডের বদলে অ্যাপস ও কিউআর কোডের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মুঠোফোনই হয়ে উঠছে লেনদেনের বড় মাধ্যম।
বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনের ৩০ শতাংশ ‘ক্যাশলেস’, তথা ডিজিটাল মাধ্যমে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে।
গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল লেনদেন যত বেশি বাড়বে, আর্থিক স্বচ্ছতা তত নিশ্চিত হবে, যা বৈষম্য কমাতেও কাজে দেবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল সেবা ঘরে বসে নেওয়া যায়, ফলে বিশেষ সুবিধা কেউ পাবে না। এতে অনিয়মও দূর হবে।
মোস্তফা কে. মুজেরী আরও বলেন, দেখতে হবে, এসব সেবায় মাশুল যেন বেশি না হয়। সেটা যেন সবার নাগালের মধ্যে থাকে।
কত গ্রাহক
দেশে একসময় এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আরেক ব্যাংকে জমা রাখতে হতো। কারণ, আন্তব্যাংক লেনদেনের ব্যবস্থা ছিল না। এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংক গ্রহণ করত না। পরে চেক গ্রহণ শুরু হয়, কিন্তু গ্রাহককে অপেক্ষা করতে হতো বেশ কয়েক দিন। এখন চেক জমা দিলে দিনের মধ্যেই টাকা পেয়ে যান গ্রাহক। এটা সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল ব্যবস্থায় ‘নিকাশঘর’ বা চেক ক্লিয়ারিং ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সেবাটি চালু হয়।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম যন্ত্র স্থাপন শুরু করে কয়েকটি ব্যাংক। যার মাধ্যমে কার্ড দিয়ে নগদ টাকা তোলার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দেশে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত জানুয়ারি মাসে ডেবিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৫২ লাখ। ক্রেডিট কার্ড রয়েছে ২৪ লাখ ২৯ হাজার। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে মোট গ্রাহক প্রায় ৮৫ লাখ। বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মুঠোফোনে আর্থিক সেবায় গ্রাহক প্রায় ২২ কোটি। উল্লেখ্য, এক ব্যক্তির একাধিক কার্ড ও হিসাব থাকতে পারে।
সব কার্ড দিয়ে এটিএম ও বিক্রয়কেন্দ্রে (পয়েন্ট অফ সেলস) লেনদেন করা যায়। ব্যাংকগুলো নিয়ে আসছে নিজস্ব অ্যাপ, যার মাধ্যমে মোটামুটি সব ধরনের লেনদেন করা যায়। ফলে কার্ডের দিনও ফুরিয়ে আসছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ সহজেই সেবা নিতে চায়। ব্যাংকগুলোও সেদিকে ঝুঁকছে। ডিজিটাল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো, এর সুফলও পাচ্ছে। ডিজিটাল লেনদেনে সব রেকর্ড সহজেই থাকছে, যা দেশের জন্য ভালো।
সমস্যাও আছে
ডিজিটাল লেনদেন মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি কিছু সমস্যাও আছে। সমস্যা তিনটি। প্রথমত, মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে লেনদেন যতটা সহজ, মুঠোফোনে আর্থিক সেবায় একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে (যেমন বিকাশ, রকেট ও নগদ হিসাবের মধ্যকার লেনদেন) ততটা সহজ নয়। তৃতীয়ত, কিছু কিছু সেবা নেওয়া যায় শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব ব্যবহার করে। ফলে মানুষকে একাধিক হিসাব খুলতে বাধ্য হতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারণা ঠেকাতে মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানকেও সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে। মোবাইলে আর্থিক সেবায় একটি সেবাদাতা থেকে অন্য সেবাদাতার হিসাবে যাতে সহজে টাকা লেনদেন করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। সব সেবা সব প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত করাও দরকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস–২০২৩ প্রতিবেদন বলছে, দেশের ১৫–এর বেশি বয়সী জনসংখ্যার ২৮ শতাংশের ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব রয়েছে। মুঠোফোনে আর্থিক সেবার হিসাব রয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশের।
দেশের আরও বেশি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করলে ডিজিটাল লেনদেন বাড়বে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার কম। স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়লে ডিজিটাল সেবা আরও বিকাশ হতো।