চট্টগ্রামের বড় পাইকারি বাজার আছদগঞ্জের রামজয় মহাজন লেনের গোলসেন পার্ক ভবন। এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয় থেকে ভবনটির দূরত্ব ২০০ মিটার। এই ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে চার প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ভবনটিতে এই চার প্রতিষ্ঠানের একটির অফিস থাকলেও বাকি তিনটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার যে প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে, সেটিও বন্ধ।
ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক বলছে, চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণের সুবিধাভোগী মূলত এস আলম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠান চারটির মধ্যে মেসার্স ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্স ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। আর লার্নড বিজনেস হাউস, ডেলিগেট ইন্টারন্যাশনাল ও স্টার ব্রাইট ইন্টারন্যাশনাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে যথাক্রমে ২৮০, ২৭৪ ও ২৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে যখন এই ঋণ দেওয়া হয়, তখন দুটি ব্যাংকই ছিল এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) নিজে। আর ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর ছেলে আহসানুল আলম।
এক ভবনে দুই ব্যাংকের চার গ্রাহক
গত ২২ জানুয়ারি খাতুনগঞ্জ হয়ে আছদগঞ্জের রামজয় মহাজন লেনের গোলসেন পার্ক ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের বাইরে ঝুলছে এস আলমের মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ইকুইটি ম্যানেজমেন্টের সাইনবোর্ড। পুরোনো এই ভবনে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে দেখা গেল অগ্রণী ব্যাংকের আছদগঞ্জ করপোরেট শাখা ও ভিশন ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের শাখা।
ভবনটির চতুর্থ তলার ঠিকানা ব্যবহার করে লানর্ড বিজনেস হাউস ও ডেলিগেট ইন্টারন্যাশনাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫৫৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু ভবনটির চতুর্থ তলায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী লার্নড বিজনেস হাউসের মালিক চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সৈয়দ আজহারুল ইসলাম এবং ডেলিগেট ইন্টারন্যাশনালের মালিক পটিয়ার জাহাঙ্গীর আলম। ভবনে গিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ফোন দুটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আমি নতুন যোগদান করেছি। টাকা উদ্ধারে যত বিকল্প আছে, আমরা তার সব চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তবে একই তলায় এস আলমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আভিভা ইকুইটি ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তা সাইদুল ইসলামের কাছে প্রতিষ্ঠান দুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, ২০১৫ সাল থেকে তিনি এই ভবনে অফিস করছেন। এ সময়ের মধ্যে এই দুই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান তিনি দেখেননি।
এ ছাড়া ভবনটির ষষ্ঠ তলার ঠিকানা ব্যবহার করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠান স্টার ব্রাইট ইন্টারন্যাশনালেরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ঋণের নথিপত্রে প্রতিষ্ঠানটির মালিক জনৈক ইয়াকুব আলী চৌধুরী। তবে একই তলার ঠিকানা ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্সের কার্যালয়ের সন্ধান পাওয়া গেল, তবে সেটি তালাবদ্ধ।
ব্যাংকের নথিপত্রে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনছারুল আলম চৌধুরী। তাঁর বাড়ি বাঁশখালী উপজেলায়, যেখানে গড়ে উঠেছে এস আলমের মালিকানাধীন এস এস পাওয়ার। আনছারুল আলম চৌধুরী একসময় এস আলম গ্রুপে কর্মরত ছিলেন বলে খাতুনগঞ্জে আলোচনা রয়েছে। ব্যাংকে দেওয়া নথিপত্রে তিনি ভোজ্যতেল, ঘি উৎপাদন ও ট্রেডিং ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করার দুই বছরের মধ্যেই ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখা থেকে হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পেয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির ১৯৩তম সভায় এই ঋণ অনুমোদিত হয়। তখন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. সেলিম উদ্দিন।
— ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্স ইসলামী ব্যাংক থেকে ১,২৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়। লার্নড বিজনেস হাউস, ডেলিগেট ইন্টারন্যাশনাল ও স্টার ব্রাইট ইন্টারন্যাশনাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে যথাক্রমে ২৮০, ২৭৪ ও ২৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়।
— চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলসেন পার্ক ভবনে শুধু ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্সের অফিস আছে।
যোগাযোগ করা হলে আনছারুল আলম চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘি ও ডালডা তৈরির কারখানা করেছি কর্ণফুলী নদীর পাড়ের ইছানগরে। এখন ঋণপত্র খুলতে পারছি না বলে উৎপাদন শুরু করতে পারছি না। কারখানা চালু হলে ব্যাংকের পুরো অর্থই শোধ করে দিতে পারব।’ এ সময় এস আলমের সঙ্গে তিনি তাঁর সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইছানগরে অবস্থিত ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্সের কারখানার নিবন্ধনের মেয়াদ রয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।
এস আলমের অফিসে
গোলসেন পার্ক ভবন থেকে নেমে হেঁটে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এস আলম গ্রুপের অফিসে পৌঁছালাম। অফিসের নিচে কোনো গাড়ি নেই। লোকজনের তেমন যাতায়াতও দেখা গেল না। অফিসের পাশের ভবনে ইসলামী ব্যাংকের এটিএম/সিআরএম যন্ত্র। একসময় আছদগঞ্জের এই অফিস থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন এস আলম। ব্যবসা বাড়তে থাকলে তিনি ঢাকায় অফিস খোলেন। ২০১৭ সালে একাধিক ব্যাংক দখলের পর এস আলম গ্রুপের ভবনে তাঁকে আর দেখা যায়নি বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ী। এর বড় কারণ, তিনি বেশির ভাগ সময়ই সিঙ্গাপুরে থাকতেন। তবে এস আলম না এলেও ভবনটিতে দামি গাড়ি চেপে আসতেন কিছু ব্যবসায়ী। এস আলম এখন দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়ে সিঙ্গাপুরে স্থায়ী হয়েছেন।
আমরা এস আলম গ্রুপের অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। অভ্যর্থনা থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো কেউ কথা বলবেন না। এরপর আমরা গেলাম খানিক দূরত্বের ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায়। ওই শাখা থেকেই এস আলম গ্রুপ বিভিন্ন নামে ৫০ হাজার কোটির বেশি টাকা তুলে নিয়েছে। তবে পুরো ব্যাংকে এস আলম গ্রুপ ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়ের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
এস আলম ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর বিভিন্ন সময় খাতুনগঞ্জ শাখার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে প্রধান কার্যালয়ের ঋণ বিভাগের দায়িত্ব পান। এসব কর্মকর্তা এস আলমকে নামে-বেনামে ঋণ দেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুহাম্মদ কায়সার আলী, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ সাব্বির, মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম ও মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক জামাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। টাকা উদ্ধারে যত বিকল্প আছে, আমরা তার সব চেষ্টা করে যাচ্ছি।’