ব্যাংকে আমানত কমেছে ঢাকাসহ ছয় বিভাগে, বেড়েছে শুধু রাজশাহী ও চট্টগ্রামে

বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়া বন্ধ রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে প্রচলিত ও ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে চাহিদামতো টাকা না পাওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে দেশের ব্যাংক খাতে আমানত কিছুটা কমে হয়েছে ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা, যা এপ্রিল–জুন প্রান্তিক শেষে ছিল ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বরে ঢাকাসহ ছয় বিভাগে আমানত কমলেও রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে বেড়েছে। সার্বিকভাবে এই প্রান্তিকে আমানত কমেছে ১৩ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। এর আগে টানা চার প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল। এর মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল-জুনে আমানতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ; যা জানুয়ারি-মার্চে ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও ২ দশমিক ১ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুনের শেষে চট্টগ্রাম বিভাগে আমানত ছিল ৩ লাখ ৮৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। একই সময়ে রাজশাহী বিভাগে আমানত ৭৪ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকায় ওঠে।

সর্বশেষ জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি আমানত ছিল ঢাকা বিভাগে আর সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে। এই সময় দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ৬১ শতাংশই ছিল ঢাকা বিভাগে। আবার শহরাঞ্চলে যত আমানত আছে, তার ৫৫ দশমিক ৭৪ শতাংশই ঢাকা বিভাগের। তবে জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই বিভাগের আমানত আগের প্রান্তিকের চেয়ে ১ দশমিক ১২ শতাংশ কমেছে, যা আগের চার প্রান্তিকে টানা বেড়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষে ঢাকা বিভাগের আমানত কমে হয় ১১ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা; যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১১ লাখ ২৫ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বিভাগেই আমানত কমেছে ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।

দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। এমন বাস্তবতায় ঢাকা বিভাগের আমানত বেশি হবে, সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কিন্তু ব্যবধানটা আকাশ-পাতাল হওয়া কাম্য নয় বলে মনে করেন তাঁরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। এমনকি অনেক মানুষ সঞ্চয় ভাঙছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তার জেরেও মানুষের আয় কমেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকের আমানত যে কমবে তা অস্বাভাবিক বিষয় নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক।

আমানতের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রসঙ্গে মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম এই দুটি বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে এই দুই বিভাগে আমানত বেশি থাকারই কথা। এই ব্যবধান দূরীকরণে তেমন কিছু করা হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। দেশের মোট আমানতের ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ রয়েছে এই বিভাগে। অর্থাৎ, দেশের মোট আমানতের প্রায় ৮২ শতাংশই এখন আছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে। বাকি ১৮ শতাংশ রয়েছে বাকি ছয় বিভাগে।

জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের মোট আমানতের সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছিল ময়মনসিংহ বিভাগে, যা পরিমাণে ২৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। এর আগের চার প্রান্তিকের মধ্যে তিনটিতে এই বিভাগের হিস্যা ছিল ১ দশমিক ৬২ শতাংশ, অন্য প্রান্তিকে ছিল ১ দশমিক ৬০ শতাংশ।

অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে দেশের মোট আমানতের মধ্যে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ খুলনা বিভাগের; ৪ দশমিক ১২ শতাংশ রাজশাহী বিভাগের; ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ সিলেট বিভাগের, ১ দশমিক ৯৫ শতাংশ রংপুর বিভাগের এবং ১ দশমিক ৯৫ শতাংশ বরিশাল বিভাগের।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকের আমানতের সুদহারও বেড়েছে। মুদ্রার বিনিময় হারও স্থিতিশীল হয়েছে। তা সত্ত্বেও জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে। এর কারণ খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির স্বতন্ত্র সদস্যরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সর্বশেষ সভায় (৩ ডিসেম্বর) নীতি সুদহার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।