ছদ্মনামে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালা
গত এক দশকে সংকটে পড়া বেশির ভাগ ব্যাংক পরিচালনা করেছেন মনোনীত প্রতিনিধিরা। এসব ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয় বেনামি কোম্পানির নামে। মূল মালিক এস আলম গ্রুপ আড়ালে থেকেই এসব ব্যাংক খালি করে ফেলে। এমন পরিস্থিতি যাতে আর না ঘটে, সে জন্য ২ শতাংশের বেশি শেয়ারধারীর প্রকৃত সুবিধাভোগী মালিক বা আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনার্সের (ইউবিও) তথ্যভান্ডার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেউ পৃথক প্রতিষ্ঠানের নামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শেয়ার ধারণ করলে তা–ও এই হিসাবের আওতায় আসবে।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত রোববার একটি নতুন নীতিমালা সব ব্যাংকে পাঠিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কী পদ্ধতিতে শেয়ারের প্রকৃত সুবিধাভোগী বের করা হবে, তা জানিয়ে দিয়েছে। চিঠিতে ব্যাংকগুলোকে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যেকোনো উপায়ে ২ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ারধারক ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ২ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ারের সুবিধাভোগীও এর আওতায় পড়বেন। ঘোষিত শেয়ার ধারণের কাঠামো স্বচ্ছ বা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শেয়ারহোল্ডারের উপযুক্ত নথিপত্র উপস্থাপনের নির্দেশ দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো অসংগতি পেলে আইনগত ব্যবস্থা ও মালিকানা কাঠামো পরিবর্তনেরও নির্দেশ দেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, শেয়ার ধারকের তথ্য প্রতি প্রান্তিক শেষ হওয়ার পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে হবে। আগামী বছরের জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিক থেকে এই তথ্য দিতে হবে। সে আলোকে শেয়ারের প্রকৃত মালিকানার বিষয়ে ‘ইউবিও ডেটাবেজ’ তৈরি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে একটি প্রান্তিক চলমান অবস্থায় মালিকানা পরিবর্তন হলে তাৎক্ষণিকভাবে সে তথ্য জানাতে হবে। কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে ব্যাংক কোম্পানি আইনে তার শেয়ার রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতিমালা প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, একটি ব্যাংকের মালিকানা কাঠামোর অস্বচ্ছতা সেটির প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়ন ও মূলধনের আসল চিত্র যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অন্তরায়। এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কঠিন করে তুলেছে। এটি বেসরকারি খাতের ব্যাংকের আর্থিক সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিবন্ধক। এ রকম অবস্থায় ব্যাংকের প্রকৃত মালিকানা কাঠামোতে স্বচ্ছতা আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকে শেয়ার বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট তথ্যভান্ডার থাকতে হবে। আর এসব তথ্যের সঠিকতার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শেয়ার বিভাগের প্রধান এবং কোম্পানি সচিব দায়বদ্ধ থাকবেন। এ-সংক্রান্ত কোনো ভুল তথ্য দিলে ব্যাংক কোম্পানি আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় আরও বলা হয়, ব্যাংকের মালিকানা সম্পর্কিত তথ্য একক গ্রাহকের ঋণসীমা, বড় ঋণের সীমা, ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগ ও ব্যাংক অনুমোদনের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ব্যাংক সম্পর্কিত কোম্পানি বা ব্যক্তি খোঁজার কাজেও ব্যবহার করা হবে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাংকের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, সেই নীতিমালা প্রণয়ন করে। এসব মেনে চলার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে তদারকি না করায় ব্যাংক খাতে বড় আকারে বেনামে শেয়ার ধারণ করে বেনামে ঋণ নেওয়া হয়। ফলে পুরো খাত এখন সংকটে পড়েছে।