কিছু না করেই সঞ্চয়পত্রে আইএমএফের শর্ত পূরণ

সঞ্চয়পত্র
প্রতীকী ছবি

সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে প্রতিবছর সরকার যে ঋণ নিচ্ছে, তার বিপরীতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ সুদ দিতে হচ্ছে। এ সুদ জনগণের করের টাকা। বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত সপ্তাহে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। ঋণের সঙ্গে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ এখন যা আছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির সুদ ব্যয় কমিয়ে আনতেই সংস্থাটি এ শর্ত দিয়েছে।

আরও পড়ুন

বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা অন্যান্য খাত থেকে আসবে। আইএমএফ আগামী সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনতে বললেও চলতি অর্থবছরেই এ খাত থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্য মোট অভ্যন্তরীণ ধারের ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ আইএমএফের শর্তের মধ্যেই আছে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল সোমবার কথা বলে জানা গেছে, আইএমএফের এ শর্ত সরকার সহজেই পূরণ করতে পারবে। কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিয়েই শর্ত পালন করা যাবে বলে এখনই এ ব্যাপারে সরকার কিছু করার পরিকল্পনা করছে না। কারণ, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা, শেষ পর্যন্ত সেই লক্ষ্য পূরণ না–ও হতে পারে। কারণ, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি এমনিতেই নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছেন গ্রাহকেরা। ফলে প্রকৃত বিক্রি বাড়েনি, উল্টো এ ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ এক বছর আগে একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ৯ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল।

খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের কর রিটার্নের সনদ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, গ্রাহকের মোবাইল নম্বরের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সার্ভারের সংযুক্তি, ই-কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) জমা দেওয়ার বিধান চালু করায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমে গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজের একটা শ্রেণির জন্য সঞ্চয়পত্রটা দরকার। কিন্তু এখন তো উল্টো স্রোত দেখা যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের যে অর্থ ঋণ নেওয়ার কথা, ছয় মাসের চিত্র বলছে সেটা এবার হচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের এখন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আর আইএমএফ সাড়ে তিন বছরে যেখানে নামিয়ে আনতে বলছে, এখনই তা আছে। আমি বলব সংস্থাটির এ–বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা তাই অতি নমনীয় হয়েছে।’

আরও পড়ুন

সরকার কী কী করবে

অর্থ বিভাগের ‘সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ: অগ্রাধিকার কার্যক্রমগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা’ নামের একটি কর্মসূচি রয়েছে। আগামী বছরের জুনে এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তার আগেই কর্মসূচিটির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। আর প্রণয়ন করা হয়েছে তিন বছরের জন্য মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র। অর্থ বিভাগের লক্ষ্য হচ্ছে এ খাতে অনলাইন অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) ব্যবস্থা জোরদার করা।

আরও পড়ুন

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আইএমএফের মিশন ঢাকায় এসে বৈঠক করার পরই গত ডিসেম্বরে অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি) বৈঠক হয়। এতে সঞ্চয়পত্র খাতে অধিকতর স্বচ্ছতা আনা ও ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।

আলোচনায় উঠে আসে, সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে গ্রাহকের মোবাইল নম্বরের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্যভান্ডারের সংযুক্তি আছে বর্তমানে। তবে গ্রাহকের টিআইএন তথ্যভান্ডারের সঙ্গে সংযুক্তি নেই। তাই প্রকৃত গ্রাহকই যাতে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন, সে জন্য সরকারের টিআইএন তথ্যভান্ডারের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের টিআইএন মিলিয়ে দেখা হবে।

আরও পড়ুন

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা উন্মুক্ত হলো এক সপ্তাহ আগে। তার আগে থেকেই এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের প্রস্তুতি রয়েছে। যেমন সঞ্চয়পত্র কেনাবেচার পদ্ধতি এখনো পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আসেনি। ফলে সরকারের সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থার (আইবাস++) সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের হিসাবও এখন পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারছে না সরকার। এ কারণে প্রতি মাসে যথাসময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হিসাব অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। আবার বর্তমানে যাঁরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের এনআইডির ফটোকপি ও ই-টিআইএনও জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে টিআইএনের বিষয়টি পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। অর্থ বিভাগের কাছেও তা ধরা পড়েছে।

অর্থ বিভাগ আরও দেখেছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেউ সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেললে, মুঠোফোন নম্বর ও নমিনির পরিবর্তন হলে সঞ্চয়পত্র গ্রাহকদের তথ্য জালিয়াতির আশঙ্কা রয়েছে। এ জালিয়াতি রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে একবার ব্যবহারযোগ্য পাসওয়ার্ড (ওটিপি) পদ্ধতির উন্নয়ন করতে হবে মনে করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের কোনো গ্রাহক মারা গেলে নগদ টাকা পাওয়া পর্যন্ত অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। এ দীর্ঘসূত্রতা দূর করার পরিকল্পনা করছে মন্ত্রণালয়।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের পণ্য হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। তবে সরকারের দিক থেকে এটা যেহেতু ঋণ, তাই এ–বিষয়ক সব ধরনের সিদ্ধান্ত আসে অর্থ বিভাগ থেকে।

অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমএফের শর্ত আমাদের মাথায় আছে। তবে ছয় মাসে বিক্রি এতটাই কমে গেছে যে এখন আমরা ভাবছি এ সময়ে কীভাবে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ানো যায়।’