ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোই চ্যালেঞ্জ
ব্যাংক খাত ঠিক না করলে অর্থনীতিতে গতি ফেরানো কঠিন হবে। তাই বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করা প্রয়োজন।
ব্যাংকে এখনো ডলারের সংকট চলছে। অন্যদিকে টাকার সংকটের কারণে চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় প্রায় অর্ধডজন ব্যাংকে লেনদেন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় টাকার জোগান দিয়ে এসব ব্যাংকে লেনদেন চালু রেখেছে। পাশাপাশি প্রভাবশালীদের মালিকানায় থাকা ব্যাংক ও তাদের ঋণগুলো থেকে যাচ্ছে তদারকির বাইরে। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার চেষ্টা ব্যাংক খাতে ভীতি ছড়িয়েছে। ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগ।
ব্যাংক খাতে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি এখনো বেশি। বারবার ছাড় দেওয়ায় এখন ঋণ আদায়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। খেলাপি ও বেনামি ঋণ এখনো লাগামছাড়া। এমন বহুমাত্রিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে পুরো ব্যাংক খাত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এত ধরনের সমস্যা ব্যাংক খাতে আগে কখনো দেখা যায়নি। তবে এর মধ্যেও কিছু ব্যাংক ভালো করছে।
কাটেনি ডলারের সংকট
দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংকগুলো বড় যে সমস্যায় ভুগছে, তা হলো ডলারের সংকট। ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়েই জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্য মূল্য এবং পরিবহন ভাড়া বেড়ে যায়। দেশে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের মার্চ-এপ্রিল সময়ে শুরু হয় ডলার–সংকট। ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আশ্বাস দেন, ‘ডিসেম্বর নাগাদ ডলার-সংকট কেটে যাবে।’ এরপর প্রায় দেড় বছর হতে চললেও ডলার-সংকট কাটেনি।
এরপর ২০২৩ সালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরেকবার আশ্বাস দেওয়া হয় যে ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে। এখন আবার নতুন করে বলা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে।
এখন খেলাপি ঋণ উদ্ধার করা, সুশাসন ফেরানো ও টাকা-ডলারের সংকট কাটানো ব্যাংক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরানোও বড় কাজ। আমরা আশা করছি, এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সবাই সমান সহযোগিতা পাবে।অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো ব্যাংক খাত। কারণ, ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্পের পুঁজি জোগান থেকে শুরু করে চলতি মূলধন ও অন্যান্য সব অর্থায়ন হয় ব্যাংক থেকে। তাই ব্যাংক খাত ঠিক না করলে ধীর হয়ে পড়া সার্বিক অর্থনীতিতে শিগগিরই গতি ফেরানো কঠিন হবে। এ জন্য আগামী বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করা প্রয়োজন। না হলে এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন খেলাপি ঋণ উদ্ধার করা, সুশাসন ফেরানো ও টাকা-ডলারের সংকট কাটানো ব্যাংক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরানোও বড় কাজ। আমরা আশা করছি, এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সবাই সমান সহযোগিতা পাবে।’
এখনো চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। এত দিন ডলারের বাজার নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘ সময় নিজেরাই ডলারের দাম ঠিক করে দিত। পরে ব্যাংকগুলোর হাতে এ দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও পরোক্ষভাবে দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখত।
সংকটের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত গত মাসে ক্রলিং পদ্ধতি চালু করে ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বলেছে ১-২ টাকার মধ্যে দর ওঠানামা করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে ডলারের গড় দাম ছিল ১১৭ টাকা ৯১ পয়সা। দুই বছর আগে ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। তবে এখনো অনেক উদ্যোক্তাকে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি দায় শোধ করতে হচ্ছে।
ডলারের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২ সালের নভেম্বরে মোট রিজার্ভ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে, যা এখন কমে হয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার, যা দিয়ে তিন মাসের কম সময়ের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।
২০২৩ সালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরেকবার আশ্বাস দেওয়া হয় যে ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে। এখন আবার নতুন করে বলা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে।
সুদহার নিয়েও বিশৃঙ্খলা
২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যবসায়ীদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে দেয়। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও পুরোনো ঋণের সুদ কমিয়ে নেন। এতে বেড়ে যায় ঋণের প্রবাহ, বেশি বাড়ে অনুৎপাদনশীল খাতে। ২০২২ সালের পরে সৃষ্ট হওয়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণে গত বছরের জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে স্মার্ট পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঋণের সুদহার সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত মেনে গত মাসে সুদহার বাজারভিত্তিক করায় ঋণের সুদ ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
হঠাৎ সুদহার বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ঋণের সুদ বাড়লেও শিল্পায়নে সমস্যা হয় না বলে মনে করেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো ঋণ চান। ঋণ পেলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান হয়। এতে ব্যবসাও ভালো হয়। তাঁদের জন্য সুদহার বড় কোনো সমস্যা না।
বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাত
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু অদূরদর্শী ও অসময়োপযোগী নীতি-উদ্যোগ এবং ঘোষণায় আর্থিক খাতে বিভিন্ন সময়ে অস্থিরতা দেখা গেছে। মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সময়মতো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সাম্প্রতিক কালে কিছু ব্যাংককে দুর্বল ঘোষণা করে আমানতকারীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আবার জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। ১৫টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তদারকির আওতায় চললেও এগুলোর উন্নতি হচ্ছে না।
অন্যদিকে একটি গ্রুপের মালিকানাধীন পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের চলতি হিসাবে বড় রকমের ঘাটতি থাকার পরও তাদের ঋণ বিতরণ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে বিশেষ ব্যবস্থায় ধার দেওয়া হচ্ছে। এমন নীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিজেই পরিবর্তন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে মালিকানা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলো নিজেরা নিলেও এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই পর্ষদ পরিবর্তন করে দেয়। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। ন্যাশনাল ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে এমন তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁরা চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গ্রুপের পরিবারের সদস্য ও আইনজীবী। ফলে মালিকানা বদলে দেওয়ার পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালক পদটিকেও বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বেশি অনিয়ম-জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন ব্যাংক ও তাদের ঋণ তদারকি করা যাচ্ছে না। অবশ্য অন্যদের ক্ষেত্রে এখন বেশ কড়াকড়ি মনোভাব দেখাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৯ সালে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা গত ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। তবে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্থিক খাতে এখন বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকগুলো যেভাবে চলছে, সেভাবে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। কিছু শরিয়া ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে চালু রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। বড়দের জন্য এক নিয়ম, অন্যদের জন্য আলাদা—এমন প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, এমনিতে ব্যাংক খাত প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ জন্য জোর করে ব্যাংক একীভূত করার দিকে যেতে হয়েছে। রাজনীতি ঠিক না হলে আর্থিক খাত সহজে ঠিক হবে না। এ জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্যাংক খাত ঠিক করার উদ্যোগ নিতে হবে। সংস্কার না করে এখন আর এ খাতের উন্নয়ন করার সুযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। সঞ্চয়, বিনিয়োগ কমে যাবে। মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।