৯০ দিন অনাদায়ি থাকলেই খেলাপি হবে ব্যাংকঋণ
ব্যাংকঋণের মান নির্ধারণে আবারও আন্তর্জাতিক চর্চা শুরু করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোনো ঋণ পরিশোধ না করলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন অতিক্রম করলে খেলাপি হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান কঠোর করল বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল বুধবার খেলাপি ঋণ বিষয়ে সর্বশেষ নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নীতিমালা আগামী বছরের এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হবে।
ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন, নতুন নিয়ম কার্যকর করার পর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কারণে ব্যাংকের মুনাফাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রাজনীতি–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও বড় ঋণখেলাপিদের চাপে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা শিথিল করেছিল। বর্তমানে কোনো ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার এক বছর সময় পর্যন্ত গ্রাহক খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পান। ফলে গ্রাহক নতুন করে ঋণ নিতে পারেন।
ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন, নতুন নিয়ম কার্যকর করার পর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কারণে ব্যাংকের মুনাফাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এতে দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ অনেকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদেও খেলাপি ঋণের বিষয়ে কঠোর নীতিমালা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি তা ধরে রাখতে পারেনি। নীতিমালায় দফায় দফায় নানা ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও শিথিল ওই নীতিমালার আওতায় খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মালিকানা বদল হওয়া ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ অনেকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে সরকারি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। যেমন সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, আর বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলো তিন মাস ভিত্তিতে ঋণের মানসংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে, ফলে এপ্রিল মাস থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে।
কেন নীতিমালায় পরিবর্তন
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ১২ বছর পর নতুন নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কার করার জন্য ইতিমধ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে আলোচ্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত গুণমান নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করে। পাশাপাশি আগামী বছরের জুনে এই নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো তিন মাস ভিত্তিতে ঋণের মানসংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে, ফলে এপ্রিল মাস থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে।
সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে হলে নিম্নমান হিসেবে খেলাপি হবে। ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সন্দেহজনক এবং ১২ মাস বা এর বেশি হলে মন্দ/ক্ষতিজনক মানে খেলাপি হবে।
নীতিমালায় যা আছে
বর্তমানে ব্যাংকঋণের ধরন ও খাত বিবেচনায় ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার এক বছর পর পর্যন্ত গ্রাহকের খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ রয়েছে। কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৯ মাস পর তা খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়। কৃষিঋণের ক্ষেত্রে কিস্তি শোধ না করেও ১৫ মাস পর্যন্ত সময় পান কৃষকেরা। অন্যদিকে শিল্পঋণের ক্ষেত্রে চলতি ঋণ, মেয়াদি ঋণ ও ডিমান্ড ঋণের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের পর সেসব ঋণ খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়।
নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ/সমন্বয়ের জন্য নির্ধারিত দিনের পরবর্তী দিন থেকে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে হলে নিম্নমান হিসেবে খেলাপি হবে। ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সন্দেহজনক এবং ১২ মাস বা এর বেশি হলে মন্দ/ক্ষতিজনক মানে খেলাপি হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতিমালার ফলে ব্যাংকঋণের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে বলে মনে করছি। বিষয়টি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। এতে সাময়িকভাবে ব্যাংকের মুনাফা কমে যেতে পারে। তবে এর ফলে ব্যাংকগুলো নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়ায় আরও মনোযোগী হবে।মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
খেলাপি হওয়ার সময়সীমা কমিয়ে আনার পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এতে কমবে ব্যাংকের মুনাফাও। নতুন নিয়মে নিয়মিত ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ স্থিতির ওপর ১ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে। ‘স্পেশাল মেনশন’ হিসাবের ক্ষেত্রে ঋণ স্থিতির ওপর ৫ শতাংশ সঞ্চিতি রাখতে হবে। ঋণ অনাদায়ি হওয়ার দুই-তিন মাসের সময়কে স্পেশাল মেনশন হিসেবে গণ্য করা হবে।
এ ছাড়া বিরূপ মানে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নিম্নমান হলে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার হবে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক হলে সঞ্চিতি হার হবে ৫০ শতাংশ ও মন্দ/ক্ষতিজনক মানে খেলাপি হলে সঞ্চিতি হার হবে শতভাগ।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতিমালার ফলে ব্যাংকঋণের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে বলে মনে করছি। বিষয়টি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। এতে সাময়িকভাবে ব্যাংকের মুনাফা কমে যেতে পারে। তবে এর ফলে ব্যাংকগুলো নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়ায় আরও মনোযোগী হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এই নীতিমালার প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকিং খাতকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে সহায়তা করবে। তবে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে যাওয়ার শঙ্কা বাড়বে। অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যবসা–বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে আসার পর এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো ভালো হতো।