ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মোকাম্মেল হক চৌধুরীও পিকে হালদারের পথে
পি কে হালদার ও মোকাম্মেল হক চৌধুরী—দুজনই এস আলমের ঘনিষ্ঠ ও তাঁর ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ছিলেন।
গত বুধবার থেকে আত্মগোপনে আছেন মোকাম্মেল চৌধুরী, নতুন এমডি শফিউদ্দিন আহমেদ।
দুটি গাড়ি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি ইউনিয়ন ব্যাংক।
বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার শীর্ষ পদে থেকে যেভাবে কমপক্ষে পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করে পালিয়েছেন, ঠিক একই পথে হেঁটেছেন ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীও। তাঁরা দুজনই বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি ছিলেন। এই পদে থেকেই নিজস্ব ও অন্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। তাঁরা দুজনই সুযোগ বুঝে আলাদা সময়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আবার এস আলমের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন পি কে হালদার। সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে পি কে হালদার ২০১৯ সালে ভারতে পালিয়ে যান। এখন অবৈধভাবে নাগরিকত্ব নেওয়াসহ নানা অভিযোগে ভারতের কারাগারে আটক আছেন তিনি। সরকার পরিবর্তনের পর মোকাম্মেল হক চৌধুরীও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে সফল না হয়ে গত বুধবার থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। এখন হয়তো দেশ ছাড়ার পথ খুঁজছেন। ব্যাংকের এমডি পদে থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা দেশে খুব বিরল।
এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী নিরুদ্দেশ হওয়ায় ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শফিউদ্দিন আহমেদকে। পাশাপাশি এমডি ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনায় ব্যাংক সাধারণ ডায়েরি করতে চাইলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি; বরং পরিবারকে তা করতে পরামর্শ দিয়েছে।
এদিকে মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ব্যবহৃত দুটি গাড়ি এখনো তাঁর বনানীর বাসার গ্যারেজে পড়ে রয়েছে। দুটি গাড়িই ব্যাংকের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে। ব্যাংকের চালকেরা সেই গাড়ি নিতে গেলে তা বুঝিয়ে দেয়নি ভবনটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। ব্যাংক আজ সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় সেই গাড়ি আনার চেষ্টা করবে বলে জানা গেছে।
ব্যাংকটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার থেকে নতুন করে যাত্রা করবে ইউনিয়ন ব্যাংক। যত তথ্য গোপন করা হয়েছিল, সেগুলো বের করা হবে। এত দিন যাঁরা ঋণসংক্রান্ত অনিয়মে জড়িত ছিলেন, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। তারাই বের করবে কে কত টাকা নিয়েছে। তারল্যসংকট মেটাতে ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমডিকে খুঁজে না পাওয়ায় অন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।ফরীদউদ্দীন আহমদ, চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন ব্যাংক
এমডি মোকাম্মেল এখন কোথায়
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, মোকাম্মেল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও বেশ আগে থেকেই তিনি অন্ধকার জগতের সঙ্গে পরিচিত। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগমুহূর্তে ও পরে তাঁর সঙ্গীরা অনেকেই পালিয়ে যান। তবে মোকাম্মেল হক পালাতে পারেননি। ইউনিয়ন ব্যাংকের ভুতুড়ে হিসাবে নির্বাচনের আগে অস্বাভাবিক অর্থ উত্তোলন এবং ব্যাংকের অর্থসংকট থাকার পরও তিনি নিজের হিসাব থেকে পুরো অর্থ তুলে নেন। এটি আলোচনায় এলে তাঁকে নজরদারিতে রাখা শুরু করে একটি সংস্থা। এরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
আরেকটি সূত্র জানায়, নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়তে মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনও হয়। তবে তিনি সফল হননি। এরপর মোকাম্মেল হক চৌধুরী নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়তে আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদেরও বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত তাঁরাও কেউ সফল হননি।
জানা গেছে, স্থল, নৌ ও বিমানপথে মোকাম্মেল হক চৌধুরীর দেশ ছাড়ার ওপর লিখিত নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও তাঁকে যেতে দেওয়া হবে না। কারণ, তাঁর অনিয়ম নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশ ছেড়ে চলে গেলে এসবের সত্যতা জানা এবং তাঁকে বিচারের আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া এস আলমের লুণ্ঠিত অর্থের খোঁজ পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হতে পারেন মোকাম্মেল হক চৌধুরী।
সম্প্রতি ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি রহস্যময় হিসাব থেকে নগদ টাকা উত্তোলন ও মোকাম্মেল হকের নিজের হিসাব থেকে পুরো অর্থ তুলে নেওয়ার বিষয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে চলে যান মোকাম্মেল হক চৌধুরী। এর আগে সোমবার দুপুরে তাঁর স্ত্রী নাজনীন আকতার দুই ছেলে–মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বাসা ছাড়েন। পরিবার ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
এস আলমই নিয়েছে ৬৫% ঋণ
ইউনিয়ন ব্যাংক হলো আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর একটি। ব্যাংকটির প্রায় ৬৫ শতাংশ ঋণ একাই নিয়েছে এই গ্রুপ, যা পরিমাণে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে কাল্পনিক লেনদেনের মাধ্যমে, যার বিপরীতে কোনো জামানতও নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আবার ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ছে বলে ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তারা জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ ৪ শতাংশের কম।
নানা অনিয়মের কারণে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়া এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত আগস্ট মাসে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকটি এস আলমমুক্ত হয়। ব্যাংকটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক। এরপরও ব্যাংকটিতে এস আলমের প্রভাব কমেনি। কারণ, মোকাম্মেল হক চৌধুরীর প্রভাবে অন্যরা ভূমিকা রাখতে পারছিলেন না। ব্যাংকটিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ, ট্রেজারি, শাখা কার্যক্রম পরিচালনাসহ কয়েকটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি বিশেষ সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছেন। ফলে পরিচালকেরা ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র জানতে পারছেন না।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটি স্বয়ংক্রিয় তথ্যভান্ডার থেকে এস আলমসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও লেনদেনের তথ্য সরিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রকৃত তথ্য বের করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন নতুন পরিচালক ও কর্মকর্তারা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরীদউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। তারাই বের করবে কে কত টাকা নিয়েছে। তারল্যসংকট মেটাতে ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমডিকে খুঁজে না পাওয়ায় অন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’