সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে কেন, তিন মাসে কমল ৩১%
দেশে সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই–সেপ্টেম্বরে ১৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ কমেছে।
দেশের আর্থিক সূচকের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটিতে জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি, আসল পরিশোধ ও সর্বশেষ স্থিতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের নগদায়নও (ভাঙানো) কমে গেছে। এ কারণে এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্রের আসল পরিশোধ বাবদ সরকারের খরচও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এ বছরের জুলাই–সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্রের আসল বাবদ গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে সঞ্চয়পত্রের আসল পরিশোধ বাবদ সরকারের খরচ কমেছে ১৬ হাজার ২৬২ কোটি টাকা বা প্রায় ৭১ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ধনী গোষ্ঠীর অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিও শ্লথ হয়েছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া বিল–বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বিল–বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে তাঁরা এখন দৈনন্দিন খরচের চাপ সামলে আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যাঁরা নামে-বেনামে এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাঁদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা আরও বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকের মাধ্যমে যেসব গ্রাহক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছিলেন এমন কয়েকটি ব্যাংক সেসব গ্রাহকদের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ও আসল বাবদ প্রাপ্য টাকা দিতে পারছে না। ফলে মানুষের মধ্যে এখন নগদ টাকা হাতে রেখে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও আসল পরিশোধ বাবদ খরচ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জুলাই–আগস্টে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার। তার বিপরীতে সঞ্চয়পত্রের আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৬ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকায়। বিক্রি কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের নিট স্থিতিও কমেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের নিট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর মানে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের স্থিতি এক বছরে ১১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা বা সোয়া ৩ শতাংশের মতো কমেছে।
এক সময় সঞ্চয়পত্র ছিল দেশে সবচেয়ে বেশি সুদের বিনিয়োগ পণ্য; কিন্তু বর্তমানে ট্রেজারি বিল–বন্ডের সুদহার সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি। আবার ব্যাংকের ঋণের সুদহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমানতের সুদও এখন ঊর্ধ্বমুখী। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৩ বছরের বেশি মেয়াদের আমানতে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের আমানতের সুদহার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদহারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ফলে বেশি মুনাফার কারণে সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের যে প্রবল আগ্রহ ছিল, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বিল–বন্ড ও ব্যাংকের আমানতে উচ্চ সুদের কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ যতটা কমেছে, তার চেয়ে বেশি কমেছে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাওয়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই দুটি শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমেছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে তাঁরা এখন দৈনন্দিন খরচের চাপ সামলে আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যাঁরা নামে–বেনামে এক সময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতেন, তাঁদেরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ কমেছে। আবার কিছু ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারায় মানুষের মধ্যে নগদ টাকা রেখে দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।