কালোটাকা সাদা করতেই কি ৭৩০ কোটি টাকার ‘প্রবাসী আয় নাটক’ সাজালেন প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান

কালোটাকাপ্রতীকী ছবি

করমুক্ত ও নগদ প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে বিদেশ থেকে এক ব্যবসায়ী ৭৩০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এনেছেন। গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এমন চমকপ্রদ তথ্য দেওয়ার পর বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তবে কে এই ব্যবসায়ী, কীভাবে এত টাকা আনলেন—এসব কিছুই বলেননি এনবিআর চেয়ারম্যান।

এনবিআর চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্যের পর এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাটি চার বছর আগের। ৭৩০ কোটি টাকা নয়, ৭২১ কোটি টাকা চীন থেকে প্রবাসী আয় আনা হয়েছে। ওই ব্যবসায়ী ঢাকার কর অঞ্চল-৫–এর একজন করদাতা। ছোট ব্যবসায়ী তিনি। ওই ব্যবসায়ী এই বিপুল অর্থ ওয়েজ আর্নার্স হিসেবে তাঁর কর নথিতে দেখিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের ওপর কর না থাকায় তিনি বিদেশ থেকে আনা ওই অর্থের ওপর কোনো কর দেননি। উল্টো নগদ প্রণোদনা নিয়েছেন। বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হতো। কিন্তু সেটি হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রবাসী আয়ের নামে বিদেশি থেকে বিপুল অর্থ এনেছেন প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুকী হাসান। দেশে এই গ্রুপের আবাসন, সেবাসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসা আছে।

মূলত কালোটাকা সাদা করতেই ওই ব্যবসায়ী প্রবাসী আয়ের নাটক সাজিয়েছেন। দেশ থেকে পাচার করা ও কমিশন–বাণিজ্যের অর্থ আনা হতে পারে বলে মনে করছেন কর কর্মকর্তারা। আবার পুরো টাকাই যে ফারুকী হাসানের, তা–ও নয়। এই অর্থ তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালীদের হতে পারে বলে ধারণা করছেন কর গোয়েন্দারা। ইতিমধ্যে ফারুকী হাসান ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন, চায়না শিপবিল্ডিং ও অফসোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি—এ তিন চীনা প্রতিষ্ঠান থেকে ৯ বছর ধরে বিপুল এই অর্থ প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এসেছে।

কর অঞ্চল-৫–এর তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরেই ২৬৯ কোটি টাকা দেশে আসে। তার আগের ২ বছরে যথাক্রমে ৭৭ কোটি ও ৮১ কোটি টাকা এসেছে। এ ছাড়া অতীতের আরও ৪ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। কর নথিতে পুরোটাই প্রবাসী আয় হিসেবে দেখানো হয়। এই সময়ে কর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তা করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কেন প্রবাসী আয়ের আওতায় করমুক্ত রেখে ছেড়ে দেওয়া হলো, তা নিয়ে এনবিআরের কর গোয়েন্দা ইউনিট এখন তদন্ত করছে। এ ছাড়া এই অর্থ আসলে কার, তা–ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মূলত দুর্নীতি–অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে পরে নগদ প্রণোদনার সুযোগ নিতে দেশে আনা হয়ে থাকতে পারে। একদিকে প্রবাসী আয় দেশে আনলে তা করমুক্ত থাকে এবং এ নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠে না, তাই এ সুযোগ নেওয়া হয়েছে। আবার বিদেশি কোম্পানির কমিশন–বাণিজ্যের অর্থও আসতে পারে। তবে যে শিল্পগোষ্ঠীর কথা বলা হচ্ছে, তার ব্যবসার পরিসর এত বড় নয়, তাই ওই ব্যবসায়ীর বিদেশ থেকে আনা বিপুল অর্থ আনার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

যেভাবে কালোটাকা সাদা হতে পারে

পাচার করা টাকা দেশে আনতে ‘প্রবাসী আয়’ হিসেবে তা দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এ ব্যবস্থায় বাণিজ্যের আড়ালে পাচার করা অর্থ কিংবা হুন্ডি করা অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে পরে তা প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে আনা যায়। তখন কর দিতে হয় না। কর নথিতে বৈধ হয়ে যায় এই টাকা। আবার দেশে কাজ পাইয়ে দিয়ে বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নিতে পারেন প্রভাবশালীরা। সেই টাকা বিদেশে লেনদেন হয়। কিন্তু ওই অর্থ দেশে এনে বৈধ করতে চাইলে করমুক্ত সুবিধায় প্রবাসী আয় হিসেবে আনতে পারেন। তখন তা বৈধ হয়ে যায়। এমনকি প্রবাসী আয় হিসেবে অর্থ দেশে আনলে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তাও পাওয়া যায়।