পরিচালক পদের পর ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারও ছেড়ে দিচ্ছে সৌদি কোম্পানি
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পরিচালনা ও মালিকানা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে সৌদি আরবের কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সি। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের পরিচালনা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার পর তাদের হাতে থাকা শেয়ারও বিক্রি করে দিচ্ছে।
আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সির হাতে থাকা ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করার পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। তাঁর কথায়, ‘ভালো মুনাফা পাওয়ায় সৌদি কোম্পানিটি শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে।’ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকে এর সঙ্গে সৌদি কোম্পানিটি যুক্ত হয়েছিল।
এর আগে ইসলামী ব্যাংকের পুরো শেয়ার ছেড়ে দিয়ে পরিচালনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। তারও আগে বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই দেশি-বিদেশি শেয়ারধারীরা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ছেড়ে দিতে শুরু করে। এসব শেয়ারও কিনে নিয়ে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় এস আলম গ্রুপ।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকটি এখন তারল্যসংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না। এ জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাংকটির জরিমানা হচ্ছে। আবার চেক ক্লিয়ারিং ও অনলাইনে টাকা স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত হিসাবেও চাহিদামতো টাকা রাখছে না। এ অবস্থায় মাঝেমধ্যে টাকা ধার দিয়ে ব্যাংকটির লেনদেন কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি সপ্তাহে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) পাঠানো ইসলামী ব্যাংকের এক চিঠিতে বলা হয়, সৌদি আরবভিত্তিক কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সি গত ৫ জুলাই একটি চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে তারা ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকবে না। এরপর ২৬ জুলাই পরিচালনা পর্ষদের সভায় তা অনুমোদিত হয়। আরবসাসের পক্ষে মুসাইদ আবদুল্লাহ এ আল-রাজি দীর্ঘদিন ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইসলামী ব্যাংকের ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক আরবসাস ট্রাভেলস।
তবে কেন আরবসাস ট্রাভেলস পরিচালক পদ ছেড়ে দিল, সে বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের চিঠিতে কিছু বলা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান যে আরবসাস ট্রাভেলস পরিচালক পদ ছাড়ার পাশাপাশি তাদের হাতে থাকা শেয়ারও বিক্রি করে দিচ্ছে।
প্রথম আলোকে মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘ভালো মুনাফা পাওয়ায় সৌদি কোম্পানিটি শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে। ৪০ বছর ধরে তারা আমাদের সঙ্গে ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ইসলামি ধারার ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। যেসব দেশে ইসলামি ব্যাংক নেই, তারা সেসব দেশে যাবে।’
যখন শেয়ারের দাম আরও চাঙা ছিল, তখন না ছেড়ে এখন ছাড়ছে কেন, এমন প্রশ্ন করা হলে মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘তারা ৪০ বছর ধরে মুনাফা পেয়েছে। তারা শেয়ার ছাড়ায় ভালো হয়েছে। দেশের কোম্পানিগুলো তা কিনতে পারছে। এটা দেশীয় সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।’
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম আটকে আছে ফ্লোর প্রাইসে। গতকাল মঙ্গলবার সে দামেই, অর্থাৎ ৩২ টাকা ৬০ পয়সায় ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘ব্যাংকটির অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। এটা দেশের জন্য অশনিসংকেত। এতে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখানো কমিয়ে দেবেন। যদিও আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানা উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছি। ’
প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকটিকে অর্থ সাহায্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে অনিয়মগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের টেকসই ক্ষমতা ও দক্ষতা কমে যাচ্ছে। এতে দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে ব্যাংক খাতের অবদান কমে যাবে।’
মালিকপক্ষের প্রতিনিধি পরিবর্তন
এদিকে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি নিজেদের মধ্যে শেয়ার হাতবদল এবং পর্ষদে প্রতিনিধিও পরিবর্তন করেছে। জুলাইয়ে ইসলামী ব্যাংক আরমাডা স্পিনিং মিলসের মনোনীত আবু সাঈদ মোহাম্মদ কাসেম, কিংসওয়ে এনডেভার্সের মনোনীত শওকত হোসেন ও ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেসের মনোনীত জামাল মোস্তফা চৌধুরীকে শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ইসলামী ব্যাংকে এই ৩ প্রতিষ্ঠানের ১১ শতাংশ শেয়ার আছে।
এর আগে জুনে এসব কোম্পানি ব্যাংকটির পরিচালনা থেকে সরে দাঁড়ায়। ওই সময় ব্যাংকের পর্ষদে এই তিন কোম্পানির মনোনীত পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক নাজমুল হাসান, অধ্যাপক সেলিম উদ্দিন ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল মতিন।
আবার গত জুনেই এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমকে জেএমসি বিল্ডার্সের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। এখন তিনিই ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন।
কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
ইসলামী ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। তখন থেকেই জামায়াতে ইসলামী-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটি পরিচালনা করেছে। ২০১১ সালের নভেম্বরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন নিয়ম চালু করে, কেউ তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক হতে হলে তাঁর হাতে ওই প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। এ বিধান করার পর ব্যাংকটিতে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্যে কিছুটা ভাটা পড়তে শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০১৭ সালে বাজার থেকে শেয়ার কিনে ব্যাংকটির মালিকানায় চলে আসে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। এরপর দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি ও ব্যক্তি ব্যাংকটির শেয়ার ছেড়ে দিতে শুরু করেন। এসব শেয়ারও কিনে নেয় গ্রুপটি। এখন তারা এককভাবে ব্যাংকটি পরিচালনা করছে।
গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ইসলামী ব্যাংকে ঋণসংক্রান্ত অনিয়মের নানা ঘটনা উঠে আসে। এরপরও কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। উল্টো টাকা ধার দিয়ে ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।