২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কোটি টাকা থাকা সেই গৃহকর্মীর স্বামীকে ব্যাংকের কর্মকর্তা বানান এস আলম

বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের গৃহকর্মী মর্জিনা আকতারের ব্যাংক হিসাবে অন্তত ১ কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এখন জানা যাচ্ছে, সেই গৃহকর্মীর স্বামী সাদ্দাম হোসেনকে ইসলামী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তা (এসপিও) পদে সরাসরি নিয়োগ দিয়েছে তাঁর মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ। গত মে মাসে এই নিয়োগ দেওয়ার সময় ব্যাংকের নিয়োগ সম্পর্কিত নিয়মের ব্যত্যয় করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নিয়োগের পর সাদ্দাম হোসেনকে প্রথমে পদায়ন করা হয় ব্যাংকটির চট্টগ্রামের দক্ষিণ জোনে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁকে চট্টগ্রামের চকবাজার শাখায় পদায়ন করা হয়। ব্যাংকে তিনি পরিচিত এস আলমের লোক (এস আলম’স ম্যান) হিসেবে। পদায়নের পর তিনি নিয়মিত অফিস না করলেও এখন তিনি অফিসে যাচ্ছেন। ইসলামী ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন

সাইফুল আলমের চট্টগ্রামের বাসায় এক দশক ধরে কাজ করেছেন গৃহকর্মী মর্জিনা আকতার। এনবিআরের যে তদন্ত দল এস আলম পরিবারের সদস্যদের কর ফাঁকির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে, তারা ইসলামী ব্যাংকে মর্জিনা আকতারের নামে থাকা ২২টি হিসাবে এক কোটি টাকার বেশি স্থায়ী আমানতের সন্ধান পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেওয়া হয়, যেখানে চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলমের ছেলে আহসানুল হক।

আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার পর প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয় এস আলম গ্রুপ। তাঁদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলে চাকরিচ্যুত করার দাবি করেছেন ব্যাংকের পুরোনো কর্মীরা। কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই নামে-বেনামে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই এস আলম গ্রুপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ।

নতুন কর্মী নেওয়ার ধারাবাহিকতায় গত ১৩ মে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি ইসলামী ব্যাংকে এসপিও হিসেবে নিয়োগ পান সাদ্দাম হোসেন। তাঁর মূল বেতন ধরা হয় ৫৫ হাজার টাকা। তবে সব মিলিয়ে প্রতি মাসে এক লাখ টাকার বেশি বেতন-ভাতা পান তিনি।

এনবিআরের যে তদন্ত দল এস আলম পরিবারের সদস্যদের কর ফাঁকির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে, তারা ইসলামী ব্যাংকে মর্জিনা আকতারের নামে থাকা ২২টি হিসাবে এক কোটি টাকার বেশি স্থায়ী আমানতের সন্ধান পেয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাদ্দাম হোসেনকে যখন নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ছিলেন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন। তিনি সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। সাদ্দাম হোসেনের নিয়োগের সময় জীবনবৃত্তান্ত ছাড়া আর কোনো নথিপত্র ব্যাংকে জমা পড়েনি। এরপরও তাঁকে নিয়োগ দেন আকিজ উদ্দিন। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকে এসপিও পদে সরাসরি নিয়োগের কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু এমন একজনকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁর ব্যাংকিংয়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিল না।

ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণেরা কর্মকর্তা পদে যোগ দেন, এরপর তিন বছর পর তাঁরা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। এরপর মুখ্য কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তা (এসপিও) পদে পদোন্নতি মেলে। এসপিও হতে কারও কারও ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। অথচ সাদ্দাম হোসেন সরাসরি এসপিও পদে নিয়োগ পেয়েছেন।

ব্যাংকে জমা দেওয়া নথিপত্র অনুযায়ী, সাদ্দাম হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মুন্সিরহাটের দক্ষিণ বাগবেড়ে। তাঁর বয়স ৩১ বছর ৮ মাস। ২০০৭ সালে এসএসসি ও ২০১০ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করেন তিনি। ২০১৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ২০১৯ সালে।

ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণেরা কর্মকর্তা পদে যোগ দেন, এরপর তিন বছর পর তাঁরা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান। এরপর মুখ্য কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তা (এসপিও) পদে পদোন্নতি মেলে। এসপিও হতে কারও কারও ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। অথচ সাদ্দাম হোসেন সরাসরি এসপিও পদে নিয়োগ পেয়েছেন।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আকিজ উদ্দিন ইসলামী ব্যাংক ছেড়ে গেছেন। এমনকি তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তাঁর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। এ ছাড়া আকিজ উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতা আছে এমন চার প্রতিষ্ঠানের হিসাবে থাকা ১০০ কোটি টাকা জব্দ করেছে সংস্থাটি।

নিয়োগের পর সাদ্দাম হোসেনকে প্রথমে যেখানে পদায়ন করা হয়, সেই দক্ষিণ জোন ওই এলাকার শাখাগুলোর নিয়ন্ত্রক কার্যালয়। সেখানকার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এস আলম’স ম্যান হিসেবে পরিচিত সাদ্দাম হোসেনের কোনো কাজ ছিল না এবং তিনি নিয়মিত অফিসেও আসতেন না। সবাই তাঁকে ভয় পেত।

এদিকে এস আলমের ক্ষমতা ব্যবহার করে সাদ্দাম হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মর্জিনা আকতারের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার সরকারি পুকুর এবং জনসাধারণের যাতায়াতের রাস্তা দখলেরও অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে স্থানীয় প্রশাসন। এরই মধ্যে কিছু জমি উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে কিছু সরকারি জমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। শেষ হলেই পুরো চিত্র বের হবে।

নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যাংকে নিয়োগ ও সরকারি জমি দখলের অভিযোগের বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এনবিআরের কর অঞ্চল-১৫-এর একটি অনুসন্ধানী দল এস আলম পরিবারের কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্ত করছে। ওই তদন্ত এখনো চলমান রয়েছে।

জানা গেছে, মর্জিনা আকতারের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বেশ কয়েকটি হিসাব খোলা হয়। শহরের প্রবর্তক মোড়ে অবস্থিত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায় মর্জিনা আকতারের হিসাবে গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে নথিপত্রে দেখা গেছে। তবে ওই হিসাবে আর উত্তোলনযোগ্য অর্থ নেই বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।

ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক—দুটোই এস আলম গ্রুপের মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুল আলম নিজেই। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক দুটি এস আলমমুক্ত করা হয়।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান। তাঁর সরকারের আমলে যেসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে, তাদের অন্যতম এস আলম গ্রুপ। গত এক দশকে সাইফুল আলম ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যবহার করে ব্যাংক দখল, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে দুই লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এস আলমের বিরুদ্ধে।