দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি এড়ানো মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত
>সারা বিশ্বের মতো করোনায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। হাতে গোনা কিছু শিল্পকারখানা ছাড়া বেশির ভাগেরই চাকা ঘুরছে না। কর্মহীন বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন গৃহবন্দী। এরই মধ্যে অর্থনীতিতে তার নানামুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে করোনায় অর্থনীতিতে কতটা ক্ষত তৈরি করবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও এ ক্ষত যে শিগগিরই কাটবে না, সে ব্যাপারে একমত অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। অর্থনীতির চাকা সচল করতে করণীয় কী, এ নিয়ে দিয়েছেন নানা পরামর্শ। তাই নিয়ে এই আয়োজন।
নিঃসন্দেহে অর্থনীতি এখন নিম্নমুখী। করোনার কারণে আমদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দেশে টাকা পাঠানো কমে গেছে, বলতে গেলে প্রবাসী আয়েও ধস নেমেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও সমস্যার মধ্যে পড়েছে। পরিবহনসংকট চারদিকে। তাই পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না।অন্যদিকে কৃষি খাতে বোরো ধান কাটার সময় এসেছে। সাধারণত অন্য জেলা থেকে কৃষিশ্রমিকেরা বোরো ধান কাটতে আসেন। কিন্তু করোনার কারণে চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ থাকায় তাঁরা আসবেন কীভাবে? সময়মতো এই কৃষিশ্রমিকেরা খেতে–খামারে থাকতে পারবেন কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, এবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসবে। সরকারি তরফ থেকে বলা হয়েছে, গতবার ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়। অনাহারে যেন কারও মৃত্যু না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে। রপ্তানি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত এই প্রণোদনা পাবে। শ্রমিকদের বেতন–ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। করোনার কারণে যাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের সরকার ভাতা দিতে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু এই সুবিধাগুলো বাস্তবায়নের সময় তদারক করতে হবে, যাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম না হয়।
আমি মনে করি, দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকেই বেশি নজর দিতে হয়। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি এড়ানোই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কেননা এমন পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকের কেনার সামর্থ্য থাকে না। সেই পরিস্থিতি যেন না হয়। বিশেষ করে শহরের রিকশাচালক, দিনমজুর যাঁরা বিপন্ন হয়ে পড়েছেন, তাঁরাই বেশি সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। সার্বিকভাবে বলতে গেলে এ পর্যন্ত সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো সঠিক পথেই আছে, তবে বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা বেশি। তাই আগামী বাজেটে শুল্ক-করে কিছু প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। তবে এখন বাজেট ঘাটতি নিয়ে চিন্তা করা ঠিক হবে না। সাধারণত বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে। এবার বাড়লেও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শুধু বাজেট ঘাটতির অর্থ কীভাবে আসবে, তা যেন সঠিক ও সাশ্রয়ী উপায়ে হয়। কারণ, এবার রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে খুব বেশি অর্থ পাওয়া যাবে না। কারণ, যাঁদের সঞ্চয় আছে, তাঁরা তা খরচ করে ফেলছেন। অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে নতুন সঞ্চয় হবে না। আর ব্যাংক থেকে ইতিমধ্যে বিপুল ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। নতুন করে ঋণ নিতে গেলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারের সামনে দুটি পথ আছে। সেগুলো হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার করা এবং বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়া।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : অর্থ উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার