ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে ব্যাংকের বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত
>২৫ বছরে পা রাখছে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের শরিয়াহভিত্তিক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল)। গতকাল ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর পূর্ণ করেছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। কেমন চলছে ব্যাংকটি, ২৪ বছরে কতটুকু এগোল। এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কাজী ওসমান আলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন
প্রথম আলো: ২৫ বছরে পা রাখছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এ দীর্ঘ সময়ে ব্যাংকটির অর্জন কী?
কাজী ওসমান আলী: দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২৪ বছরে এ ব্যাংকের গ্রাহকসংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপুলসংখ্যক গ্রাহকই আমাদের মূল শক্তি। তাঁদের সন্তুষ্টিই আমাদের বড় অর্জন। বর্তমানে দেশজুড়ে এসআইবিএলের ১৫৯টি শাখা রয়েছে। এর পাশাপাশি ১০৮টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট, ১২টি ব্যাংকিং বুথ ও ৯৬টি এটিএম বুথ রয়েছে, যা সমসাময়িক অনেক ব্যাংকেরই নেই। এ ছাড়া বিদেশের মাটিতে এসআইবিএলের সেবা সম্প্রসারণে সৌদি আরবের জেদ্দায় একটি পূর্ণাঙ্গ শাখা স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে আমরা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছি। সৌদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে লাইসেন্স পেলে দেশের বাইরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের শাখা কার্যক্রম শুরু হবে।
প্রথম আলো:আমরা দেখছি, ব্যাংক খাতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা আছে। আপনার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি কী?
কাজী ওসমান আলী: আমরা যেহেতু ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত, তাই আমাদের কোনো বিনিয়োগ ওভারডিউ বা কিস্তি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেগুলোকে মুনাফায় যুক্ত করতে পারি না। মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের আগে আমাদের ব্যাংকের বেশ কিছু বিনিয়োগের
কিস্তি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর শাখা পর্যায়ে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া অনেক বিনিয়োগকে শ্রেণীকৃত ঋণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করি, যাতে ভবিষ্যতে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। তাতে ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। আশা করছি, বছর শেষে তা আরও কমে আসবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা।
প্রথম আলো: সম্প্রতি ব্যাংক খাতে প্রকটভাবে তারল্যসংকট দেখা দেয়। আপনাদের ব্যাংকও কি এ ধরনের সংকটে পড়েছে?
কাজী ওসমান আলী: ব্যাংক খাতে কিছুদিন আগে হঠাৎ করে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছিল, এটি সত্য। পুরো খাতে এ সংকট দেখা দিলেও আমাদের ব্যাংকে কোনো তারল্যসংকট ছিল না। এখন পর্যন্ত আমরা এক দিনের জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসএলআর (সংবিধিবদ্ধ জমার হার), সিআরআর (নগদ জমার হার) সংরক্ষণে ব্যর্থ হইনি। যদি তারল্যসংকট থাকত, তবে আমাদের পক্ষে এসএলআর-সিআরআর সংরক্ষণ সম্ভব হতো না। ভবিষ্যতেও যাতে এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে না হয়, সে জন্য আমরা আমাদের আমানত পণ্যে নানা বৈচিত্র্য এনেছি। দেশের প্রবীণ বা বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক ও নারীদের জন্য আকর্ষণীয় মুনাফায় কিছু আমানত পণ্য চালু করেছি, যা গ্রাহকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। তা ছাড়া এজেন্ট ও বুথ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আমরা কম খরচে আমানত সংগ্রহ করছি। এজেন্ট ও বুথ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এরই মধ্যে এক শ কোটি টাকার বেশি আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে বর্তমানে আমাদের ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি যথেষ্ট মজবুত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলো:বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আপনাদের ব্যাংকের বিনিয়োগের বড় অংশই এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
কাজী ওসমান আলী: আমাদের ঋণের সিংহভাগ মূলত শহরকেন্দ্রিক। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের দুটি বড় শহর এবং শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশই এ দুটি শহরকেন্দ্রিক। তাই অন্যান্য ব্যাংকের মতো আমাদের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ এ দুটি শহরে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় ব্যাংক হিসেবে আমরা যখন ব্যবসা করতে যাই বা ঋণ বিতরণ করতে যাই, তখন ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে শিল্পে বিনিয়োগের খুব বেশি সুযোগ থাকে না। অর্থাৎ এ দুই বিভাগের বাইরে ব্যাংকের বড় বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত। কারণ, এখন পর্যন্ত আমাদের শিল্প, কলকারখানার সিংহভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। তারপরও আমরা খুলনা, রাজশাহী, সিলেট এলাকায় বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ব্যাংক চাইলেই তো আরেকটি এলাকায় বিনিয়োগ বা অর্থায়ন করতে পারে না। যেখানে আমি বিনিয়োগ করতে চাই, সেখানে চাহিদাও থাকতে হবে। শুধু এসআইবিএল নয়, আপনি যদি এ দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন, সবারই সিংহভাগ বিনিয়োগ হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। তা সত্ত্বেও আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ইসলামি ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও বুথ ব্যাংকিংকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছি।
প্রথম আলো: দুই যুগ পেরিয়ে এখন এ ব্যাংককে ঘিরে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
কাজী ওসমান আলী: বর্তমানে বিশ্বজুড়েই ব্যাংকিং সেবা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। গ্রাহকেরাও এখন ঘরে বসেই সব ধরনের ব্যাংকিং লেনদেন করতে চান। এই অবস্থায় প্রযুক্তিবান্ধব গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে হলে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের প্রযুক্তির নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। সে অনুযায়ী আমরা নিরাপদ ও প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং সেবার প্রসারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই বছরে এ ব্যাংকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে নিজস্ব একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে, যাতে ঘরে বসে গ্রাহকেরা এই অ্যাপ ব্যবহার করে তাঁদের দৈনন্দিন ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন। এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব একটি আধুনিক কল সেন্টার স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এটিএম সেবা দ্রুত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে এসআইবিএল আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের প্রথম সারির ব্যাংকে পরিণত হবে।