খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির তথ্য জানা যায়, দায়ী চিহ্নিত হয় না

প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে সংসদে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এখন ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। দেশে এখন দেশি-বিদেশি ৫৯টি ব্যাংকের কার্যক্রম আছে। এর মধ্যে সরকারি ৯টি ব্যাংক। আর অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মোট খেলাপির প্রায় অর্ধেকই সরকারি ব্যাংকের দখলে।

১০ বছর আগেও যাঁরা জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন, তাঁরা গর্ব করে বলতেন সরকারি খাতে সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংক হলেও, সবচেয়ে ভালো ব্যাংক জনতা। আর জাতীয় সংসদে গতকাল রোববার প্রশ্নোত্তর পর্বে অর্থমন্ত্রী জানান, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে এই জনতা ব্যাংকেই। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের প্রায় অর্ধেক। আবার গত প্রায় এক দশকে সরকারি ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করেছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।

গত ১০ বছরে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এর মধ্যে ঘটেছে একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির নাম ছিল হল-মার্ক গ্রুপ। তবে হল-মার্কের তুলনায় ছোট হলেও কেলেঙ্কারির সংখ্যা বেশি জনতা ব্যাংকেই। আর এর প্রভাব পড়েছে খেলাপি ঋণের হিসাবে।

জাতীয় সংসদে নিয়মিতভাবেই খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া যায়। সংসদ সদস্যরা নিয়মিতভাবে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন। অর্থমন্ত্রী প্রশ্নোত্তর পর্বে খেলাপি ঋণের তথ্য দেন। এমনকি অনেক সময় প্রশ্নের জবাবে ঋণখেলাপিদের তালিকাও প্রকাশ করেন। তালিকায় কিছু নাম একই থাকে, নতুন নতুন নামও যুক্ত হয়। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণও প্রতিবারই বাড়তে থাকে।

সবারই প্রশ্ন খেলাপি ঋণ এত বাড়ল কীভাবে। গত এক দশকে ঋণখেলাপিদের জন্য একাধিক সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে দু-একটি ঘটনা ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আর সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যেসব ঋণগ্রহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন পরিশোধ না করার জন্য (ইচ্ছাকৃত খেলাপি), সেসব ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপি কারা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি। ফলে খেলাপি ঋণও কমেনি।

ব্যাংক মূলত চলে সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থে। আর এই আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। সুতরাং, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, সেখানে কারা কখন দায়িত্বে ছিলেন, কার কতটা দায়—তাও কখনো চিহ্নিত করা হয়নি। সুতরাং ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তি এবং যাঁদের দায় আছে, তাঁদের দায়ী করা ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

সংসদে অর্থমন্ত্রী আরও যা বললেন

সংসদে গতকাল প্রশ্ন করেছিলেন জাতীয় পার্টির মসিউর রহমান। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়। অর্থমন্ত্রী এ সময় জানান, গত ৩০ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মোট ১ লাখ ৮২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের, সোনালী ব্যাংকের ৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৯০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৫৫৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।

মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০১৫-১৯) ব্যাংকগুলো বেশ কিছু খেলাপি ঋণ আদায় করেছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের আদায় ৫ হাজার ৩০৫ কোটি ২৯ লাখ, জনতা ব্যাংক ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৬৩ লাখ, অগ্রণী ব্যাংক ২ হাজার ৯৫৫ কোটি ৩৪ লাখ, রূপালী ব্যাংক ১ হাজার ৮৫ কোটি ৩০ লাখ, বেসিক ব্যাংক ৮৮০ কোটি ৮৬ লাখ এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ১ হাজার ৭১ কোটি ৮ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে।

ফেনী-২ আসনের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ২০০৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৪ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে।