স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশের দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরকে স্মরণ করার সময়। কারণ, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে জন্ম থেকে আজকের এই দিনে আসার পথে অনেক চড়াই–উতরাই পার হতে হয়েছে। গত পাঁচ দশকে এশিয়া ও আফ্রিকার অন্য দেশের তুলনায় আমাদের অর্জনটা প্রশংসনীয়। জাতিসংঘের কাছ থেকে আমরা সেটার স্বীকৃতিও পেয়েছি।
আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, এই শেষের শুরুটা হয় ছয় বছর আগে। ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য সব সূচক আমরা প্রথম অর্জন করি। ২০১৮ থেকে ২০২১—এই তিন বছরেও আমরা সূচকের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এবার শেষের শুরু হলো। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে গত ছয় বছর যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আগামী পাঁচ বছরও আমাদের জন্য ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকৃত শেষটা সুষ্ঠুভাবে অর্জনের জন্য আমাদের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি উদ্যমকে অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হওয়ার পর যেসব ক্ষেত্রে চাপে থাকবে, তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে রপ্তানির কথা। বিশ্ববাজারে শুল্কমুক্ত বাজার–সুবিধা আমাদের জন্য শেষ হয়ে যাবে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা থেকে অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার পথ ক্রমান্বয়ে বন্ধ হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হবে। ওষুধশিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন আরও কড়াকড়ি হবে। কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া এবং নতুন শিল্পকে সমর্থন দেওয়া সীমিত করতে হবে।
আগামী পাঁচ বছর আমাদের নজর রাখতে হবে মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারকে অব্যাহত রাখা। মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারাকে বেগবান রাখা। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন–সম্পর্কিত বিপন্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এই অর্জনের মধ্যে নারীদের প্রতি আমাদের বৈষম্যমূলক আচরণ কমাতে হবে। রপ্তানিসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাকে মোকাবিলা করতে হবে।
করোনাভাইরাস বহু কিছুই জটিল করে দিয়েছে। চলমান অতিমারি থেমে গেলেও এর প্রভাব অব্যাহত থাকবে বহুদিন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কোভিডের ক্রমপ্রকাশমান প্রভাব সম্পর্কে আমাদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দেখতে হবে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট না হয়। মূল্যস্ফীতি যাতে বৃদ্ধি না পায়।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশকে আগামী পাঁচ বছর প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে বিকাশ লাভ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই এখন মন্দা চলছে। বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ কর্মকাণ্ড এখন শ্লথ। তেলের দাম আরও বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আরও প্রকট হতে পারে। থাকবে ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভরণপোষণ ও তাদের প্রত্যাবাসনের খরচ নির্বাহের চ্যালেঞ্জও।
সাম্প্রতিককালে বিশ্ব সম্প্রদায় উন্নয়নের মাপকাঠিতে দুটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। প্রথমটি হলো—জাতীয় উন্নয়ন কতখানি অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে। অর্থাৎ দেশে আর্থসামাজিক ও প্রথাগত বৈষম্য কমছে কি না। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের পরিপূরক সুশাসন রাষ্ট্র নিশ্চিত করছে কি না। অর্থাৎ নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকার যথাযথভাবে রক্ষিত হচ্ছে কি না। তাই আগামী ৫-১০ বছরের উন্নয়নে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে সমাজে বৈষম্য কমানোর দিকে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রজীবনের সব ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
এসব পদক্ষেপকে সুসহংতভাবে এক করতে সরকারকে দ্রুত একটি উত্তরণকালীন কৌশলপত্র প্রস্তুত করতে হবে। সেই কৌশলপত্রের বিভিন্ন লক্ষ্য থাকবে। একটা হবে স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশ এখন যেসব সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে, উত্তরণকালীন কর্মসূচির ভেতরেও সেসব পদক্ষেপ কার্যকর রাখা। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলেও নতুন আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা যাতে পেতে পারি, সেসব বৈশ্বিক উদ্যোগকে কাজে লাগানো।
এটার সঙ্গে মেলাতে হবে বাণিজ্য–সুবিধা যদি না থাকে কীভাবে আরও বেশি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা যায়। কর আহরণ বাড়ানো যায়। বিদেশি বিনিয়োগ আনা যায়। মেধাস্বত্ব আইনে কড়াকড়ি হলে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোকাবিলা করা যায়।
এলডিসি থেকে উত্তরণকালীন কৌশলপত্র রচনার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের চলমান বিভিন্ন পরিকল্পনা দলিলের সঙ্গে সাসুজ৵ বিধান করা। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ১০০ বছর মেয়াদি বদ্বীপ পরিকল্পনা, জলবায়ু অ্যাকশন প্ল্যান এবং জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অ্যাজেন্ডা। এগুলো পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়নের সঙ্গে উত্তরণকালীন কৌশলকে মেলাতে হবে।
এলডিসির উত্তরণের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রম পরিবীক্ষণের জন্য সরকার ২০১৮ সালে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিকল্পনা কমিশনেরও বিশেষ ভূমিকা থাকবে। প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত দিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোকেও (বিবিএস) সাহায্য করতে হবে। এই কাজের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যুক্ত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার জন্য নিউইয়র্ক, জেনেভা, ব্রাসেলসহ অন্য মিশনগুলোকে যৌথভাবে মনোযোগী হতে হবে। ব্যক্তি খাত ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই জাতীয় উদ্যোগে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।
বলা বাহুল্য, আগামী দিনে আমাদের যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে এই উত্তরণকালীন কৌশল শক্তিশালীভাবে দেশে ও বিদেশে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে আমরা কতখানি শক্তিমত্তা নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হব। শুরুটা যেহেতু ভালো হয়েছে, শেষটাও ভালো করতে হবে।