কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, আহত শ্রমিকদের ৭৮ শতাংশই সম্পূর্ণভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা এখন পরিবারের বোঝা।
শুধু তাই নয়, আহত শ্রমিকদের চিকিৎসায় এক লাখ থেকে চার লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ৯৫ শতাংশ শ্রমিককেই নিজের চিকিৎসার খরচ বহন করতে হয়েছে। মালিক মাত্র ৪ শতাংশ শ্রমিকের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় দিয়েছেন। ১ শতাংশ শ্রমিকের চিকিৎসা বিনা মূল্যে হাসপাতাল করেছে। আর ৩৭ শতাংশ শ্রমিককে চিকিৎসার জন্য কোনো টাকাই দেননি মালিক।
‘কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত শ্রমিকদের আর্থসামাজিক অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে
এসেছে। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে গতকাল মঙ্গলবার এক সেমিনারে গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি এ গবেষণা করেছে। ঢাকা ও এর বাইরে ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত ১০০ শ্রমিকের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি করা হয়।
সেমিনারে গবেষণাটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন দ্য ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিক মাহামুদুল হক। তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ২৬০ জন শ্রমিক নিহত ও ৩৬৩ জন আহত হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশ শ্রমিক স্পাইনাল কর্ড সমস্যায় ভুগছেন। তাঁরাই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুরবস্থার শিকার হয়েছেন। প্রায় সব শ্রমিকই বলেছেন, তাঁরা মারাত্মক আর্থিক সংকটে আছেন। উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না। ৯০ শতাংশ শ্রমিক দুর্ঘটনার পর তাঁদের জীবনমান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। ৩৪ শতাংশ শ্রমিকের সন্তানের লেখাপড়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২৮ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার আগে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও এখন আর তেমন মনে করেন না। তাঁদের জীবন এখন মূল্যহীন।
গবেষণা বলছে, ৯৫ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আদায়ে মালিকের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেননি। কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মালিকের অবহেলাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে শাস্তির বিধান, শ্রম আইন সংশোধন করে আহত-নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো, শ্রমিককল্যাণ তহবিল থেকে শ্রমিকদের সহায়তার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার সুপারিশ করা হয় গবেষণায়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শ্রমসচিব মিকাইল শিপার বলেন, ‘সোয়া ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু মালিকপক্ষ তো অনেক ক্ষেত্রে সেটাও দিচ্ছে না। রানা প্লাজার ঘটনায় মালিকদের সমিতি ২ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু মালিকপক্ষ কি কোনো ক্ষতিপূরণ দিয়েছে?’
শ্রমসচিব বলেন, ‘শ্রমিককল্যাণ তহবিলে এখন ৫০ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু এখান থেকে টাকা দেওয়ার জন্য আমি লোক খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ শ্রমিকেরা অনেক বেশি অসংগঠিত।’ এই তহবিলকে ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার আশ্বাস দেন তিনি।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, শ্রমিকদের যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তা অপ্রতুল তো বটেই, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্যও নয়। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন।
বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের সম্মানীয় নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, ‘আমরা হয়তো শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশ হব। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করছি। কিন্তু একই সঙ্গে এত শ্রমিক যে মারা যাচ্ছে, এটা নিয়ে আমাদের কি মোটেও লজ্জা হওয়া উচিত না।’
সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির চেয়ারম্যান খুশী কবিরের সভাপতিত্বে সেমিনারে দুজন আহত শ্রমিক বক্তব্য দেন।