বড় আর্থিক সমস্যাগুলো নিয়ে আগে কাজ করতে হবে

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ব্যবসা–বাণিজ্য ও অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক

সায়েমা হক

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এই মুহূর্তে প্রথম ও প্রধান কাজ হবে দেশে সার্বিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। এতে সবার মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। বহুদিন ধরেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতি—এই দুটি ক্ষেত্রে সংকট চলছে; যা এখন আরও তীব্র হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার ও মুদ্রা বিনিময় হারসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঠিক রাখা এবং একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনাও চ্যালেঞ্জিং কাজ হবে।

সম্প্রতি দেশে সহিংসতা, কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটেছে; যে কারণে মানুষও স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেনি। এর ফলে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটেছে। এখন এটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরবরাহ শৃঙ্খলে যেসব মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট রয়েছে, তাদের সেই চক্রও ভেঙে দেওয়া জরুরি।

দীর্ঘদিনের ভুল ও বিলম্বিত নীতির কারণে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছে রয়েছে। এটাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা জরুরি। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য একটা শক্তিশালী ও স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বাধীন বিশেষজ্ঞরাও থাকবেন। তাঁরা বাজারের কোথাও প্রতিযোগিতার বিপরীতমুখী কাজ দেখলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। দামের পাশাপাশি খাদ্যের গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে।

আর্থিক খাতে বড় সমস্যাগুলো নিয়ে আগে কাজ করতে হবে। আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য দোষীদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে যত ভালো লোকই নেওয়া হোক না কেন, কীভাবে যেন কিছু গোষ্ঠী ঋণগুলো পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ঋণ সংজ্ঞায়িত করা, ঋণ পাওয়ার কিছু সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ঠিক করা ও ঋণ প্রদানপ্রক্রিয়া যাচাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ (বডি) থাকা দরকার। তারা বড় মাপের ঋণ ভালোভাবে পরখ করে অনুমতি দেবে। অর্থাৎ ঋণ প্রদানপ্রক্রিয়ায় যাচাই প্রক্রিয়া যত বাড়ানো হবে, খেলাপির সম্ভাবনা তত কমে আসবে। এ ছাড়া বিদ্যমান ব্যাংকিং কোম্পানি আইনটি অনেক পুরোনো ও এতে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ রয়েছে। এটির সংস্কারে হাত দেওয়া উচিত।

কর ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা জরুরি। বিশেষ করে বৈষম্য কমাতে ব্যক্তি খাতের আয়করে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতেও নজর দিতে হবে নতুন সরকারকে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার ধারায় কিছু মৌলিক জায়গায় সমন্বয় আনা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তিপর্যায়ের খরচ কমিয়ে আনতে হবে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সরকারি প্রকল্পের ব্যয় তদারকি ও মূল্যায়ন করতে হবে।

কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই কর্মসংস্থানের বিষয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। শহরকেন্দ্রিক দরিদ্রদের নিয়ে বিশেষ চিন্তা করতে হবে। জিনিসপত্রের উচ্চ দাম তো রাতারাতি কমানো যাবে না। এ জন্য টিসিবির পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি ও দামে আরও ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে।

  • সায়েমা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়